সাইবার জগৎ নিয়ে কার্যকর শিক্ষাপদ্ধতি দরকার

নারীরা সাইবার অপরাধের শিকার হন বেশি। প্রতীকী ছবি

পিরোজপুর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে ডিকে দিব্যা মনি। করোনার কারণে সরাসরি ক্লাস বন্ধ ছিল। অনলাইনে যে ক্লাস হয়েছে, তাতে গণিত, ইংরেজি, বিজ্ঞান, বাংলার মতো বিষয় বেশি প্রাধান্য পেলেও তথ্য প্রযুক্তির মতো বিষয় গৌণ হিসেবেই থাকত। এ ছাড়া এবারের এসএসসি পরীক্ষাতেও তথ্যপ্রযুক্তিসহ তিনটি বিভাগে পরীক্ষা হয়নি। দিব্য মণির মতে, সিলেবাসের বাইরে তথ্যপ্রযুক্তি বা সাইবার জগৎ, বুলিং নিয়ে আলোচনা কম হয়।

সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের ‘বাংলাদেশের সাইবার অপরাধপ্রবণতা ২০২২’ প্রতিবেদন অনুযায়ী সাইবার বুলিংয়ের শিকার ভুক্তভোগীর সংখ্যা ৫০ দশমিক ২৭ শতাংশ। সাইবার অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীদের ৫৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ নারী। এ ছাড়া ২৮ বছরের নিচের ১৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ সাইবার অপরাধের শিকার, যা আগের বছর ছিল ৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

গত সেপ্টেম্বরে গ্রামীণফোন, টেলিনর ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে অনলাইনে ‘বাংলাদেশের শিশুদের সুরক্ষা’বিষয়ক এক অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ইন্টারনেটে ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৯০ শতাংশ কমপক্ষে একবার পর্নোগ্রাফি দেখেছে।

কী আছে পাঠ্যে

সাইবার জগতে প্রতিনিয়তই পরিবর্তন হচ্ছে এবং এর ব্যাপ্তিও বাড়ছে। তবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জানায়, যুগের চাহিদায় পাঠ্যবইয়ে এখন যা আছে, এর চেয়ে আরও বেশি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া দিব্যা মণি প্রথম আলোকে বলে, সাইবার বুলিং এখন সবচেয়ে বেশি হয়। কিন্তু এ বিষয়ে বইয়ে তেমন কিছুই নেই। বই থেকে কিছু বোঝা যায় না। শিক্ষকদেরও এসব বিষয়ে ক্লাসে আরও বোঝাতে হবে।

মাধ্যমিক স্তরের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বই ঘেঁটে দেখা যায়, ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ে আইসিটি পরিচিতি, যন্ত্রপাতি, নিরাপদ ব্যবহার, ওয়ার্ড প্রসেসিং ও ইন্টারনেট পরিচিতি সম্পর্কে বলা আছে। এ ছাড়া বেশিক্ষণ ব্যবহার করলে শারীরিক ও মানসিক সমস্যা হতে পারে উল্লেখ আছে এবং ইন্টারনেট অধ্যায়ে ব্রাউজিং সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে।

সপ্তম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বইয়ে প্রাত্যহিক জীবনে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে ধারণা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সম্পর্কেও বলা আছে। ভাইরাস, হ্যাকিংয়ের কথাও আছে। এ ছাড়া অপরিচিত কাউকে ছবি, নাম–পরিচয়, পাসওয়ার্ড না দেওয়ার সচেতনতা আছে। ইন্টারনেটে অশালীন ও অসংযত আচরণ না করা, কম্পিউটার গেম, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তি, ক্ষতিকর সফটওয়্যার, ভাইরাস, পাসওয়ার্ড সুরক্ষা, ওয়েবে নিরাপদ থাকা সম্পর্কে কিছু ধারণা দেওয়া হয়েছে।

কী বলছেন তাঁরা

মাগুরার জগদল সম্মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নারগিস পারভীন শিক্ষার্থীদের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ে পড়ান। তিনি প্রথম আলোকে জানান, পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন ভিডিও, কার্টুন, তথ্যচিত্র দেখানোর চেষ্টা করেন। তবে এই শিক্ষকও মনে করেন, এখনকার পাঠ্যবইয়ে যতটুকু আছে, এর বাইরে আরও কিছু যুক্ত থাকা দরকার।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান মো. ফরহাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয় আরও ব্যাপকভাবে থাকবে। এ নিয়ে আইসিটি বিভাগের সঙ্গেও আলোচনা চলছে। এ ছাড়া সাইবার বুলিং বিষয়ে শিক্ষার্থীদের কীভাবে পড়ানো হবে, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলমান আছে।

শিক্ষার্থীদের অনেকে জানান, সাইবার জগৎ সম্পর্কে নিজ উদ্যোগেই তারা বেশি শেখে। প্রযুক্তির ব্যবহার ও সাইবার জগতে মা–বাবার চেয়ে সন্তানের বিচরণ বেশি। ফলে অধিকাংশ মা–বাবারই সঠিক ধারণা নেই সন্তানকে নিরাপদ রাখতে হলে কী করা যেতে পারে। শহরের বাইরে তা আরও বেশি।

বেসরকারি কর্মজীবী নাসিমা আক্তারের মেয়ে রাজধানীর একটি খ্যাতনামা স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ছে। সাইবার জগৎ সম্পর্কে তার ধারণা যতটুকু, তা তিনি মেয়েকে জানান। তবে এই অভিভাবক বলেন, ‘এখনকার বাচ্চারা অনেক স্মার্ট। নিজের বাচ্চাকে অনেক কিছু বুঝিয়ে রাখা গেলেও সহপাঠীদের প্রভাবে অনেকেই অনেক কিছু করে বসে।’ তিনি জানান, তাঁর মেয়ে শুধু বন্ধু ও শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে। ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অভিভাবকেরা ‘প্যারেন্টাল কন্ট্রোল’ সেট করে নিতে পারেন। তবে নাসিমা জানান, তিনি এ বিষয় সম্পর্কে অবগত নন।

দেড় বছর আগে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) নির্দেশনা অনুযায়ী ‘প্যারেন্টাল কন্ট্রোল’ সেবা দেওয়া শুরু করে ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। এর মাধ্যমে অভিভাবকেরা তার বাসার ইন্টানেট সেবায় কোন কোন সাইট থাকবে বা থাকবে না, তা নির্ধারণ করে নিতে পারেন। কিন্তু এ সেবা নেওয়ার হার ১০ শতাংশও হয়নি বলে জানান ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সভাপতি ইমদাদুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনেকেই সচেতন নন এবং জানেন না।

তথ্যপ্রযুক্তি ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, স্কুলে যাওয়ার আগে থেকেই শিশুরা ইন্টারনেটের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায় থেকেই এসব বিষয় গুরুত্ব দিয়ে পড়াতে হবে। এ ছাড়া পাঠ্যবইয়ের বাইরেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাইবার সচেতনতা কার্যক্রম চালাতে হবে, যেখানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক হবে। প্রতিবছরই প্রযুক্তির পরিবর্তন ঘটছে। তাই এ বিষয়ে পাঠ্যপুস্তকও বছর বছর পর্যালোচনা করা দরকার বলে জানান।