ক্যাম্পাসগুলোতে কীভাবে শুরু হলো শাড়ি-পাঞ্জাবি দিবস
এখন দেশের প্রায় বেশ কয়েকটি ক্যাম্পাসেই ঘটা করে আয়োজন করা হয় ‘শাড়ি-পাঞ্জাবি’ দিবস। কোনো নির্দিষ্ট দিনে নয়, একেকটি ব্যাচ কিংবা বিভাগের শিক্ষার্থীরা নিজেদের উদ্যোগে এ উৎসব আয়োজন করেন। ছেলেরা পাঞ্জাবি আর মেয়েরা শাড়ি পরে হাজির হয়ে যান। কেমন করে ক্যাম্পাসগুলোতে এ উৎসবের প্রচলন হলো, খোঁজার চেষ্টা করেছেন ফুয়াদ পাবলো
ক্যাম্পাসগুলোতে ঠিক কবে থেকে ঘটা করে ‘শাড়ি-পাঞ্জাবি উৎসব’ আয়োজন শুরু হলো, সেটার খোঁজ পাওয়া কঠিন। তবে এটুকু অনুমান করা যায়, উৎসবের শুরুটা হয়েছিল কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো এক ব্যাচের ‘বিদায়ী অনুষ্ঠান’কে কেন্দ্র করে। দিনটা যেহেতু সবাই স্মরণীয় করে রাখতে চান, তাই শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে ছবি তোলার আগ্রহ থেকেই উৎসবের জন্ম। বিভিন্ন ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেল।
ফেসবুকে ‘বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র’ নামে একটা গ্রুপ আছে। দেশের পুরোনো ছবির বেশ সমৃদ্ধ একটা আর্কাইভ গড়ে তুলেছেন গ্রুপের মডারেটররা। এই গ্রুপে ১৯৮০ সালে তোলা একটি ছবি চোখে পড়ল। ছবির মানুষটি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৎকালীন শিক্ষার্থী শিরিন হোসেন। থাকতেন রোকেয়া হলে। সে সময় মাস্টার্সের ফাইনাল পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রীতি অনুযায়ী হলের ‘র্যাগ ডে’ আয়োজনের পরিকল্পনা করেন শিরিন হোসেনসহ বেশ কয়েকজন। আলোচনা করে ঠিক হয়, র্যাগ ডে উপলক্ষে র্যালি, রং খেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং নৈশভোজের আয়োজন করা হবে। তবে পুরো অনুষ্ঠানে কীভাবে নতুনত্ব আনা যায়, তা নিয়ে ভাবতে বসেছিলেন তাঁরা। এমন কিছু করতে চাইছিলেন, যা সবাইকে চমকে দেবে। সেই চিন্তা থেকেই তাঁরা পোশাক হিসেবে বেছে নেন ‘মালা শাড়ি’। এমনিভাবে ক্যাম্পাসের বিশেষ দিনগুলোতে শাড়ি-পাঞ্জাবি পরার রীতি বেশ পুরোনো। কিন্তু ‘দিবস’ বা ‘উৎসব’ কীভাবে শুরু হলো, সেটা বলা মুশকিল। হয়তো একটি বিশ্ববিদ্যালয় শুরু করেছে, সেটির জনপ্রিয়তা দেখে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও উৎসবের রং ছড়িয়ে পড়েছে।
এই যেমন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের কথাই ধরা যাক। বিশ্ববিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু ২০০৮ সালে। যাত্রা শুরুর পর থেকে বিদায়ী অনুষ্ঠান উদ্যাপনে ‘শাড়ি–পাঞ্জাবি দিবস’ পালন করা যেন অঘোষিত নিয়ম হয়ে গেছে। প্রতিটি বিদায়ী ব্যাচ আয়োজন করে দুই দিনব্যাপী র্যাগ ডে। যেখানে প্রথম দিন পুরো আয়োজনজুড়ে থাকে শাড়ি আর পাঞ্জাবি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কটি বিভাগের শিক্ষার্থীরা একই দিনে বিদায়ী অনুষ্ঠান আয়োজন করে বলে ক্যাম্পাসজুড়েই থাকে একটা উৎসবের আমেজ। আর প্রতিটি বিভাগের আলাদা আলাদা রঙে সাজও ভিন্ন মাত্রা যোগ করে পুরো আয়োজনে। ২০২২ সালের শাড়ি–পাঞ্জাবি দিবস নিয়ে কথা হচ্ছিল বিশ্ববিদ্যালয়টির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে সদ্য স্নাতক শেষ করা সাইদুল সাব্বিরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সত্যি বলতে শাড়ি–পাঞ্জাবি দিবস আমাদের ক্যাম্পাসজীবনের একটা স্মরণীয় দিন। এই দিনে আমরা যে শুধু শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে আনন্দ করি, তা নয়; বরং এটি আমাদের জীবনে অন্য রকম গুরুত্ব বহন করে। কেননা, চার বছর একসঙ্গে চলার কারণে কখনো কখনো এমন হয় যে কারও সঙ্গে মনোমালিন্য হতে পারে। এটি এমন একটি দিন, যেখানে আমরা অতীতের মান-অভিমান ভুলে একসঙ্গে আনন্দ করতে পারি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের অন্যতম সেরা দিন এটি।’
তবে শুধু র্যাগ ডে নয়, নিছক সবাই মিলে আনন্দ করার উদ্দেশ্যেও কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে হচ্ছে এমন আয়োজন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কথা শোনা যাক। নোশিন তাবাসসুম পড়ছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশেনোগ্রাফি ও হাইড্রোগ্রাফি বিভাগে। তাঁরা কিছুদিন আগে আয়োজন করেছিলেন ‘শাড়ি–পাঞ্জাবি দিবস’। কোন ভাবনা থেকে এমন আয়োজন? নোশিন জানান, ‘আসলে আমাদের ক্যাম্পাসটি খুব ছোট। ক্লাস-ল্যাব মিলিয়ে পড়ালেখা আর কাজের প্রচণ্ড চাপ থাকে সারা সপ্তাহে। তাই অন্য সব ইউনিভার্সিটির মতো খুব জাঁকজমক করে প্রোগ্রাম আয়োজন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কিন্তু এর মধ্যেও আমরা ছোট ছোট কিছু করে হলেও বিশ্ববিদ্যালয়জীবনটা একটু আনন্দময় করে তুলতে চেষ্টা করি। সেই ধারণা, চিন্তাভাবনা, ইচ্ছা থেকেই সিনিয়র ভাইয়া-আপুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে আমরা শাড়ি–পাঞ্জাবি ডে করব। এরপর এই নোটিশ মোটামুটি সব বিভাগে দিয়ে দেওয়া হয়। নিজেদের সুবিধামতো একটা নির্দিষ্ট দিন ধার্য করে সবাই মিলে দিবসটি উদ্যাপন করেছি।’ কোক স্টুডিওর জনপ্রিয় গান ‘নাসেক-নাসেক’–এর সঙ্গে শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে নেচেছিলেন নোশিনরা। সেই নাচের ভিডিও অনলাইনে বেশ প্রশংসা পেয়েছে। নোশিন বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম দিনটাকে স্মরণীয় করে রাখতে একটু ভিন্ন কিছু করব। সে জন্যই নাচের আয়োজন। পরে ভিডিওটা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশ ভালো সাড়া ফেলেছে'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস কিংবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শাড়ি পাঞ্জাবি দিবসের এমন আয়োজন নিয়মিতই চোখে পড়ে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ক্যাম্পাসে। নাটোরে অবস্থিত বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকার আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও ছড়িয়ে পড়েছে উৎসবের রং।
সব কটি আয়োজনের মধ্যে মিল একটাই। সবাই মিলে নিজেদের মতো করে একটা আনন্দের দিন কাটানো। ক্যাম্পাসের সবাই যদি শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে হাজির হয় একদিনের জন্য, নিঃসন্দেহে পুরো প্রাঙ্গণের চেহারাই বদলে যায়।