পাবনার ২৫ গ্রামের মানুষ খেলেন জনপ্রিয় এই ইউটিউব চ্যানেলের জন্য, পুরস্কার পান নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা পণ্য
খাবার আর খেলা নিয়ে হরেক রকম প্রতিযোগিতার ভিডিওর চ্যানেল ইউটিউবের ‘এসএস ফুড চ্যালেঞ্জ’। কোনো ভিডিওতে গাপুসগুপুস মিষ্টি খাওয়ার প্রতিযোগিতায় নামেন গ্রামের মানুষ, কোনোটায় আবার তির ছুড়ে বেলুন ফাটানোর লড়াইয়ে। পুরস্কার হিসেবে অংশগ্রহণকারীরা পান চাল, ডাল, তেল, নুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। জনপ্রিয় চ্যানেলটির ভিডিও দেখা হয়েছে প্রায় ৫৫ কোটি বার। চ্যানেলটির পেছনের মানুষদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন সরোয়ার মোর্শেদ
উঠানে লম্বা একটি টেবিল পাতা। দুই পাশে গোলপোস্ট, মাঝে ১২টি ফুটো। এসব ফুটো দিয়ে মাথা বের করে আছেন ১২ জন। তাঁদের কারও গলায় হলুদ তো কারও নীল কাপড় জড়ানো, দেখতে অনেকটা ট্রাভেল পিলোর মতো। কে কোন দল, গলার কাপড় দেখে বোঝা যায়। খেলাটার নাম ‘বলে ফুঁ দিয়ে গোল’।
উঠানে জড়ো হয়েছেন নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-শিশুসহ পাড়ার শতাধিক মানুষ। খেলা শুরুর অপেক্ষা করছেন সবাই।
উপস্থাপক রাসেল রানা নিয়মকানুন বলে দিলেন, টেবিলের মাঝ থেকে ছাড়া হবে ছোট্ট একটি বল। ফুঁ দিয়ে বলটিকে গোলপোস্টে নিতে হবে। এভাবে যে দল বেশি গোল দিতে পারবে, তারাই হবে বিজয়ী।
এরপরই টেবিলের মধ্যে ছাড়া হলো ছোট্ট একটি বল। সবাই চুপচাপ হয়ে গেলেন। বাঁশিতে ফুঁ দিতেই হলুদ দলের একজন বলে ফুঁ দিয়ে গোলপোস্টের দিকে পাঠালেন। নীল দলের খেলোয়াড় সেটা ঠেকানোর চেষ্টা করছেন। শুরু হলো ফোঁকাফুঁকি। মুহুর্মুহু করতালিতে মুখর চারপাশ। ফুঁ দিয়ে দিয়ে ছোট বলটা গোলপোস্টের মুখে নিয়ে এল একদল। অন্য দল সেটা ঠেকানোর চেষ্টা করল। কিন্তু না, গোলটা হয়েই গেল। এভাবে ২-১ গোলে বিজয়ী হলো হলুদ দল। বিজয়ী দলের প্রত্যেকের হাতে তুলে দেওয়া হলো পাঁচ কেজি আটা আর তিন লিটার সয়াবিন তেল। পরাজিত দলের প্রত্যেকে পেলেন এক লিটার করে সয়াবিন তেল।
গত ২৮ আগস্ট দুপুরে পাবনার ফরিদপুর উপজেলার নেছড়াপাড়া গ্রামে এক বাড়িতে বসেছিল ব্যতিক্রমী এই খেলার আসর। ‘বলে ফুঁ দিয়ে গোল’ নামের খেলাটির পর ‘কুমিরের মুখে বল নিক্ষেপ’ নামে আরেকটি খেলা হলো। এভাবে ‘নারীদের তির দিয়ে বেলুন ফোটানো’ ও ‘কলাগাছ ডিঙিয়ে নদী পার’ নামে দুটি প্রতিযোগিতাও হলো। এর মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে এল। অংশগ্রহণকারীরা পুরস্কার আর দর্শকেরা আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন।
ভিন্নধর্মী এসব খেলার আয়োজক ইউটিউব চ্যানেল ‘এসএস ফুড চ্যালেঞ্জ’-এর ওমর সানি। পরিচিত সবাই যাঁকে সম্রাট নামেই চেনেন বেশি। তাঁর সঙ্গে কাজ করে ২০ জনের একটি দল। সানির চ্যানেলের পক্ষ থেকেই খেলার আয়োজন করা হয়, পুরস্কারও দেয় তারা। সেসব খেলার ভিডিও ধারণ করে পরে ‘এসএস ফুড চ্যালেঞ্জ’ নামে ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজে তোলা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের ভিডিওগুলো এখন দারুণ জনপ্রিয়। দেখা হয় কোটি বার।
কীভাবে শুরু করেছিলেন সানি?
চতুর্থবারে সফল
ফরিদপুরের বনয়ারীনগর গ্রামের মানুষ ওমর সানি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সন্ধ্যাকালীন এমবিএ করে চাকরি নিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়া–বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিতে। পদ ছিল চেম্বার সচিব। সেটা ২০১৬ সালের কথা। ইউটিউবে ভিডিও তৈরি করে অনেককে সফল হতে দেখে সানিরও আগ্রহ হলো। ‘পজিটিভ বাংলাদেশ’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল খুললেন। চ্যানেলটিতে বিভিন্ন মজার ভিডিও আপলোড করতেন। কিন্তু তেমন একটা সাড়া পেলেন না। ২০১৮ সালে কৌশল বদলালেন। ‘এসএস প্রতিভা’ নামে আরেকটি চ্যানেল খুললেন। গ্রামবাংলার প্রতিভাবান শিল্পীদের গান ধারণ করে প্রচার শুরু করলেন। কিন্তু কপিরাইট জটিলতায় সেই চ্যানেলও মুখ থুবড়ে পড়ল। ওমর সানি বলেন, ‘এরপর খাবারদাবারের প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ভিডিও করার কথা মাথায় রেখে “উই এক্সপ্লোরার” নামে চ্যানেল খুললাম।’
এই চ্যানেলে গ্রামের শ্রমজীবী মানুষদের নিয়ে খাবারের প্রতিযোগিতা করা হতো। একসময় এতেও বিপত্তি দেখা দিল। দ্রুত খাবার খেতে গিয়ে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। বিপদ আঁচ করতে পেরে চ্যানেলটি বন্ধ করে দেন তিনি। তখন থেকেই ভিন্ন কিছু করার কথা ভাবতে থাকেন। এর মধ্যে করোনা শুরু হলো। করোনার প্রকোপ কমে এলে ২০২১ সালে খেলা ও খাবার খাওয়ার ভিডিও তৈরি শুরু করেন। সোহেল রানা নামে ওমর সানির এক ছোট ভাই হলেন সহযোগী। ঢাকায় থেকেই সোহেলকে দিয়ে শিশুদের নিয়ে ভিডিও তৈরি করতে থাকেন। শিশুদের জন্য বিভিন্ন ধরনের খাবার নিয়ে গ্রামে গ্রামে যাওয়া হতো। বিভিন্ন খেলায় অংশ নিয়ে শিশুরা খাবার জিতে নিত। ইউটিউবে ভিডিওগুলো মানুষ মজা নিয়ে দেখতে থাকেন। বাড়তে থাকে এসএস ফুড চ্যালেঞ্জের সাবস্ক্রাইবার। আয়ও ভালো হতে থাকে।
২০২১ সালের শেষ দিকে যখন বুঝতে পারলেন তাঁর চ্যানেলটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে, চাকরি ছেড়ে গ্রামে চলে এলেন ওমর সানি। পুরোদমে শুরু করলেন ইউটিউবিং। কনটেন্ট তৈরির জন্য গড়ে তুললেন দল। মাথায় এল বড়দের নিয়ে খেলানোর চিন্তা। পুরুষদের সঙ্গে যুক্ত হলেন নারীরাও। ওমর সানি জানালেন, করোনার কারণে গ্রামের অনেক মানুষই তখন কর্মহীন। খেলার ছলে তাঁদের হাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী তুলে দেওয়ার বিষয়টি মাথায় আসে। এতে যেমন গ্রামের মানুষের মধ্যে সাড়া পড়ে, তেমনি ইউটিউবেও দর্শক বাড়তে থাকে।
ওমর সানি বললেন, ‘দেশের চেয়ে বিদেশে আমাদের দর্শক বেশি। ইউটিউব থেকে যা আয় হয়, সেটা দিয়ে আমাদের চলে যায়। এই আয় থেকেই প্রতি মাসে গ্রামের মানুষের হাতে ছয় লাখ থেকে সাত লাখ টাকার খাদ্যসামগ্রীসহ বিভিন্ন উপহার তুলে দেওয়া যায়।’
নতুন নতুন খেলা উদ্ভাবন করেন মনিরুল ইসলাম, রাশেদুল হাসান, আকাশ ও সোহেল রানা। খেলা পরিচালনা ও উপস্থাপনা করেন রাসেল রানা ও সোহেল রানা। ভিডিও ধারণ ও সম্পাদনা করেন সাগর হোসেন ও মনিরুল ইসলাম। দলের অন্য সদস্যরা অন্য সব দায়িত্ব পালন করেন।
উপস্থাপক রাসেল রানার ভাষায়, ‘পুরো পৃথিবীর মানুষ আমাদের ভিডিও দেখছেন। এর চেয়ে আনন্দের, ভালো লাগার আর কিছু নেই। তাই মানুষকে আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি নিজেদের আনন্দ ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়াচ্ছে আনন্দ
ইটভাটার শ্রমিক, মাঠের শ্রমিক ও রিকশা-ভ্যানের শ্রমিকদের নিয়ে শুরু হয়েছিল। দিনে দিনে পরিধি বেড়েছে, যুক্ত হয়েছেন নানা পেশার মানুষ। নতুন নতুন খেলা উদ্ভাবনের পাশাপাশি নতুন গ্রামে চলে যাচ্ছে এসএস ফুড চ্যালেঞ্জ দল। বর্তমানে ফরিদপুর উপজেলার নেছড়াপাড়া, বেড় হাউলিয়া, ভেড়ামারা, আরকান্দি, বাসুরিয়া, পরিন্দাপুর, পাচুয়া পাড়াসহ ২৫ গ্রামে এই খেলা হয়ে থাকে। কবে খেলা হবে, অপেক্ষায় থাকেন এসব গ্রামের মানুষ। শুটিংয়ের দিন গ্রামজুড়ে তৈরি হয় উৎসবের আমেজ।
নেছড়াপাড়া গ্রামের আজিম উদ্দিনের বয়স ৭৫ বছর। তিনিও খেলতে এসেছিলেন। তিনি জানান, বৃদ্ধ বয়সে তেমন কাজকর্ম নেই। একা একা ঘরে বসেই দিন কাটত। তখন খুব খারাপ সময় যেত। খেলা শুরু হওয়ার পর বেশ আনন্দেই কাটছে সময়। যেদিন খেলা হয়, সেদিন গ্রামের সবাই একত্র হন। গল্প-আড্ডা, খেলা, পুরস্কার—সব মিলিয়ে দিনটি বেশ কাটে।
সেদিন খেলতে এসে একটি শাড়ি, দুই লিটার সয়াবিন তেল ও দুই কেজি আটা জিতে নেন বেড় হাউলিয়া গ্রামের শিল্পী রানী। পুরস্কার জিতে হাসিমুখে বলেন, ‘মেলা বার পুরস্কার জিতিছি। এই খেলা আমাগের জীবনই পাল্টে দিছে। আনন্দ হচ্ছে, আবার মেলা কিছু পাচ্ছি।’
দর্শকদের প্রতিনিয়ত নতুন কিছু দিতে চায় এসএস ফুড চ্যালেঞ্জ। নিয়মিত সেসব নিয়েই ভাবেন সবাই। ওমর সানি বলেন, ‘আমরা শুধু নিজেদের লাভের কথা ভাবছি না। খেলাসহ বিভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে গ্রামের মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য তৈরির কথাও চিন্তা করছি। এসব আয়োজনে মানুষে মানুষে নতুন করে ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি হচ্ছে। পুরস্কারগুলোও তাঁদের কাজে আসছে।’
ওমর সানিদের ইচ্ছা, ফরিদপুরের প্রতিটি গ্রামে আয়োজনের পর পাবনার অন্য গ্রামগুলোতেও যাবেন তাঁরা।