ভাই চোর, এই চিঠি তোমার জন্য

ঢাকার কলাবাগান থেকে বাসে করে চট্টগ্রামে যাচ্ছিলেন। ফকিরাপুল যেতেই দেখেন, মাথার ওপরের তাকে রাখা আর সবই আছে, নেই শুধু লেন্সসহ ক্যামেরার দুটি ব্যাগ। সাধনার জিনিসগুলো হারিয়ে ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন আবদুল্লাহ আল মাহাদি

জানি না, এ লেখা তুমি পড়বে কি না; কখনো আমার মনের কষ্ট তোমার কাছে পৌঁছাবে কি না। তবু তোমার উদ্দেশেই এই খোলা চিঠি। যদি তোমার ঠিকানা জানতাম আর সেই ঠিকানায় চিঠিটা লিখতাম, তবে তুমি প্রতিটা হরফেই দেখতে পেতে অশ্রুর দাগ। দেখতে পেতে শীতের রাতে জ্বরাক্রান্ত শরীরেও ইভেন্ট কাভার করতে গিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকা একজন মানুষ, যে কিনা আবার গরমেও ঘামতে ঘামতে চামড়ায় ঘা বানিয়ে ফেলা একজন মানুষ। আর তার এই কষ্ট শুধু একটা ক্যামেরা কিনবে বলে। শুধু ছবির মানুষ হবে বলে যে মানুষটা দীর্ঘ সাড়ে চারটি বছর সব রকমের কষ্ট সহ্য করেছে। তুমি সেই মানুষটার স্বপ্ন, স্বপ্নের চাবিকাঠিকে চুরি করেছ।

তোমাকে আমার অনেক কথা বলার আছে ভাই। অনেক কথা। জানো ভাই, আমি ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে একটি ক্যামেরার স্বপ্ন দেখেছি। সেই স্বপ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে এসে, এই তো সেদিন আমি ছুঁতে পেরেছি। সেটাও তুমি কেড়ে নিলে। জানো, গুনে গুনে মাত্র ২৯ দিন ক্যামেরাটা আমার হাতে ছিল।

আবদুল্লাহ আল মাহাদি
ছবি: সংগৃহীত

পেশাগত কাজের জন্য দরকার হয় পেশাদার গেজেট। অনেক সাহস করে দুই লাখের বেশি টাকা ঋণ করে সেই গেজেট আমি কিনেছিলাম। আমার এ স্বপ্নের চারা তার ডালপালা মেলতে শুরু করার আগেই শিকড়সহ উপড়ে ফেললে ভাই! আমাকে বিশাল আর্থিক ঋণের সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়ে গেলে। হাপিত্যেশ করে বাঁচার এই কষ্ট কি তুমি বুঝবে?

কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কোনো ঘনিষ্ঠ সার্কেল নেই। কেন জানো? আমি ছুটে বেড়িয়েছি ইভেন্টে, কাজ করেছি। বন্ধুদের সময় দিতে পারিনি। শুধু ফটোগ্রাফি আর ফিল্ম মেকিং করব বলে ছুটে বেরিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে এসে নিজের পায়ে দাঁড়াতে গিয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জীবনকে টেনেহিঁচড়ে চালিয়ে নেয়, আমি তার সবকিছুই অতিক্রম করে আসা মানুষ। এসব কষ্ট ভুলে সুখের দিনের চাবিটা যখন হাতে পেলাম, তখনই তুমি তা খপ করে ছিনিয়ে নিয়ে গেলে।

আমার ক্যামেরাটা তো নিলেই, সেই সঙ্গে নিলে আমার অন্যতম প্রিয় মানুষ অনিক ভাইয়ের ক্যামেরাটাও। সেটাও আমার ব্যাগেই ছিল। কাজের জন্য ধার করে এনেছিলাম। সেই ক্যামেরার ইতিহাস শুনলে তুমি হয়তো চোখের পানি ধরে রাখতে পারবে না। এই ক্যামেরার প্রামাণ্যচিত্রে মান্তা সম্প্রদায়ের কিছু মানুষের জীবনমানে পরিবর্তন এসেছে, শতাধিক সুবিধাবঞ্চিত শিশু আলোর মুখ দেখেছে, পেয়েছে বস্ত্র, শিক্ষা বা চিকিৎসা। মানুষের কল্যাণের তরে বারবার আমরা সঙ্গে নিয়ে ছুটেছি এই ক্যামেরা।

জানি না, তুমি কে। তবে আমার মন বলছে, টাকার জন্যই তুমি হয়তো ক্যামেরাটা নিয়ে গেছ। তোমারও হয়তো অভাব আছে। তবু এভাবে আরেকজনকে আর কষ্ট দিয়ো না। এভাবে কারও জীবন থেকে তার স্বপ্ন কেড়ে নিয়ো না। তুমি যদি লেখাটা পড়ো, তবে ক্যামেরাটা বাজারে যে দামে বিক্রি করতে সেই দামে আমাকেই দিয়ো। আমি মূল্য দেব। সেই সঙ্গে তোমাকে আমার ক্যামেরা কেনার গল্প, ঋণের গল্প, তার পেছনের কষ্ট, অপমান বা যা কিছু ছিল, সব বলব।

শেষে শুধু বলব, তুমি আমার জীবন থেকে আমার স্বপ্নচাবিকে যেভাবে ছিনিয়ে নিয়ে গেলে, কেউ যেন তোমার কাছ থেকে প্রিয় জিনিসকে এভাবে না নিয়ে যায়। তোমার জন্য শুভকামনা রইল।