জেন-জি ও মিলেনিয়ালরা কেন সাময়িক অবসরে যাচ্ছেন

এখনকার পেশাজীবীরা ভ্রমণ বা অন্যান্য শখ পূরণে কিংবা ব্যস্ত জীবনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে শুধু ছুটি নয়, সাময়িক অবসরেই চলে যাচ্ছেনছবি: পেক্সেলস

গত শতাব্দীর আশি ও নব্বইয়ের দশকের বাংলা সিনেমায় দেখা যায়, নায়ক–নায়িকারা ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় দিন-রাত পরিশ্রম করছে। তবে এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে পরিশ্রমের ধরন বদলে গেছে। এখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছেন জেন-জিরা, মিলেনিয়ালরাও বসছেন গুরুত্বপূর্ণ আসনে। আগে কর্মজীবনকে মহিমান্বিত করতে কয়েক দশকের পরিশ্রমের পর অবসরকে দেখা হতো পুরস্কার হিসেবে। এখন জেন-জি ও মিলেনিয়াল কর্মীদের কাছে বাংলা সিনেমার সেই চিত্রনাট্য উল্টে গেছে। এখনকার পেশাজীবীরা ভ্রমণ বা অন্যান্য শখ পূরণে কিংবা ব্যস্ত জীবনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে শুধু ছুটি নয়, সাময়িক অবসরেই চলে যাচ্ছেন। এই সাময়িক অবসর বিষয়টা কী?

যেভাবে শুরু

একবিংশ শতাব্দীর একদম শুরুর দিকে ইউরোপ-আমেরিকায় যখন প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠানের বিস্তার ঘটতে থাকে, তখন থেকেই সামনে আসে সাময়িক অবসরের ধারণাটি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে সেই ধারণা গেল কয়েক বছর বেশ জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। তরুণদের এই অবসরকালীন ভ্রমণ বা রোমাঞ্চকর দিনযাপন উঠে আসছে মূলত টিকটক, ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুকের রিলসে।

২০০৭ সালে মার্কিন উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী টিমোথি ফেরিস ‘দ্য ফোর-আওয়ার ওয়ার্কউইক’ নামের এক বইয়ের মাধ্যমে এই ধারণা জনপ্রিয় করে তুলতে অবদান রাখেন। আগেই বলেছি, কাজ ও জীবনের মধ্যে ভারসাম্য আনতে সাময়িক অবসরে যাচ্ছেন মূলত জেন-জি ও মিলেনিয়ালরা। কেবল কর্মীরাই নিজ উদ্যোগে এমন অবসরে যাচ্ছেন, তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও কর্মীদের এমন অবসরকে উৎসাহ দিচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান আবার কর্মীদের টাকাপয়সা দিয়েও পাশে থাকছে। কেউ কেউ এ জন্য ৩: ১ মডেল অনুসরণ করেন। তিন বছর কাজ করে এক বছর ছুটি নেওয়াই এখন সাময়িক অবসর হিসেবে আলোচিত।

আরও পড়ুন

কেন সাময়িক অবসরে যাচ্ছেন

২০২৩ সালের ব্যবসায় পরামর্শ প্রতিষ্ঠান ডেলয়েটের এক জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৪৬ শতাংশ জেন-জি সদস্য কাজের চাপে তুলনামূলক বেশি ক্লান্ত বোধ করেন। প্রচলিত ক্যারিয়ারের পথ তাঁরা অনুসরণ করতে চান না। ৪০ বছরের অবিরাম কাজ এখন আর তরুণ পেশাদারদের কাছে মোটেও আকর্ষণীয় কিছু নয়। সাময়িক অবসর শারীরিকভাবে দুর্বল বা বার্নআউট প্রতিরোধের একটা মোক্ষম উপায় হিসেবেও বিবেচিত।

২০২৪ সালে প্রকাশিত ম্যাকিঞ্জে অ্যান্ড কোম্পানির এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৫৬ শতাংশ জেন-জি কর্মী বেতনের চেয়ে কাজ ও জীবনের ভারসাম্যকে অগ্রাধিকার দেন। আগের প্রজন্মগুলো কর্মক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা ও দীর্ঘস্থায়িত্বকে অপরিহার্য হিসেবে মানতেন। জেন-জি ও মিলেনিয়াল কর্মীরা কাজ ও জীবন—দুটির বেলায় স্বাচ্ছন্দ্য ও পরিপূর্ণতায় বিশ্বাসী। এই প্রবণতার অন্যতম কারণ হচ্ছে ফ্রিল্যান্সিং, ডিজিটাল নোম্যাড বা ডিজিটালি যাযাবর জীবন ও রিমোট জবের প্রসার। জেন-জিরা ভ্রমণ ও অভিজ্ঞতাকে বেশি গুরুত্ব দেন। এক্সপিডিয়ার ২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, জেন-জিদের ৭৪ শতাংশ বস্তুগত সম্পদের চেয়ে ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে বেশি প্রাধান্য দেন। এ কারণে তাঁরা সাময়িক অবসর বেছে নিচ্ছেন।

আরও পড়ুন

সাময়িক অবসর কি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে

পিউ রিসার্চ সেন্টারের একটি সমীক্ষা বলছে, ৬৩ শতাংশ জেন-জি কর্মী বিশ্বাস করেন, কয়েক দশক ধরে একই চাকরিতে থাকার চেয়ে কাজ থেকে বিরতি নেওয়া বেশি উপকারী। পর্তুগাল ও ইন্দোনেশিয়ার বালিতে ‘ফায়ার’ নামে একটা কনসেপ্ট বা ধারণা বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ‘ফায়ার’ হলো ‘ফিন্যান্সিয়াল ইনডিপেনডেন্স, রিটায়ার আর্লি’র সংক্ষিপ্ত রূপ। অর্থাৎ ‘আর্থিক স্বাধীনতা, আগেভাগে অবসর’।

ইউরোপের দেশগুলোতে সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টি শক্তিশালী। ফলে সেখানে সাময়িক অবসর বেশি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, এটাই স্বাভাবিক। জার্মানি ও ফ্রান্সের মতো দেশে চাকরি থেকে বিরতি নিলে বেতন ঠিকই ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়। ইউরোস্ট্যাট অনুসারে, ৪১ শতাংশ ফরাসি কর্মী ৪০ বছর বয়স হওয়ার আগে কমপক্ষে একবারের জন্য হলেও চাকরি থেকে বিরতি নিয়েছেন। ২০২৩ সালের এক জরিপে দেখা যায়, ৩৯ শতাংশ অস্ট্রেলিয়ান কর্মী চাকরিজীবনের মাঝামাঝিতে এসে একবার হলেও সাময়িক অবসর নিয়েছেন।

উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোতে সাময়িক অবসর এখনো কষ্টকল্পনা। কারণ, এসব দেশে আর্থিক স্থিতিশীলতাই বড় চিন্তার বিষয়। তবে তারপরও ভারত, ইন্দোনেশিয়াসহ বাংলাদেশের অনেক তরুণ এখন ফ্রিল্যান্সিং ও রিমোট জবে যুক্ত বলে সাময়িক অবসরে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

সূত্র: ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, দ্য গার্ডিয়ান ও ফার্স্টআপ

আরও পড়ুন