আন্দোলন যেভাবে বন্ধুত্বের ধারণা বদলে দিল

আজ বন্ধু দিবস। আমাদের দেশে দিবসটি পালিত হয় আগস্টের প্রথম রোববার। বন্ধুত্ব উদ্‌যাপনের জন্যই তো এই দিন। তবে এ বছর পরিস্থিতি একেবারেই আলাদা। ক্যাম্পাসগুলো বন্ধ, অনেক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হবে না। এমনকি ক্যাম্পাস যখন খুলবে, তখনো কারও কারও সঙ্গে দেখা হবে না আর। 

অকালে বন্ধুকে হারানোর শোকই শিক্ষার্থীদের এক করেছে
ছবি: আশরাফুল আলম

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর একটা কথা খুব শুনতাম—বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে নাকি বন্ধু হয় না।
কথাটা বিশ্বাস-অবিশ্বাস কিছুই করতে পারিনি। একদিকে যেমন ছিল হাসি, গানে, আড্ডায়, কার্ড খেলায় দিন পার করে দেওয়া, তেমনি মনোমালিন্য, ভুল–বোঝাবুঝি বা মতবিরোধের দিনও আসলে কম ছিল না।
কাজেই বন্ধুত্ব ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের প্রজন্মকে সব সময়ই একটা দ্বিধার মধ্যে থাকতে হয়েছে। বলা ভালো, থাকতে হতো।
ছোটবেলায় ঈশপের গল্প পড়েছিলাম। বন্ধু চেনার গল্প। বিপদে যে বন্ধু ভালুকের মুখে ফেলে চলে যায়, সে নকল বন্ধু। সমস্যা হলো, এই নগরজীবনে বন্ধু বাছাই করতে গিয়ে ভালুক পাব কোথায়?

এই আফসোস ঘোচাতে ‘ভালুক’ বোধ হয় চলেই এল। কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরুর দিন পনেরো পর হুট করেই আমাদের বলা হলো—এই মুহূর্তে হল ছাড়তে হবে।
সাধারণত এভাবে আমরা হল ছাড়ি উৎসবের আগে, ছুটির আগে। এবার সেই উৎসবের জায়গা নিল ভয় আর ক্ষোভ। শেষবারের মতো আলিঙ্গনের সময় আমাদের বুক কেঁপে গেল। আবার সবাইকে সুস্থভাবে দেখতে পাব তো?
না, আমরা পাইনি।
আমাদের বহু বন্ধু আহত হয়েছে, বহু বন্ধু আটক। ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেল। দমবন্ধ পরিবেশ। সেই পরিবেশ আমাদের আবার নতুন করে বন্ধু চেনাল। যার সঙ্গে মাসে একবার কথা হতো, সেও ফোন করে জিজ্ঞাসা করল, ‘ঠিক আছিস তো? সাবধানে থাকিস।’ এই কথাটুকু, এই খোঁজটুকু আমাদের সেই ‘দ্বিধা’ ভেঙে দিল পুরোপুরি। আমাদের জানিয়ে গেল, বিশ্ববিদ্যালয়েও বন্ধু হয়।
কেউ আহত হয়েছে? দশজন দৌড়ে আসছে। কেউ আটক হয়ে আছে? সবাই ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছে। যে শান্ত ছেলেটা কোনো দিন গলা উঁচু করে না, সে-ও চিৎকার করে বলছে, ‘আমার ভাইয়ের মুক্তি চাই। দিতেই হবে।’
একটা আন্দোলন শুধু শত্রু বাড়ায় না, বন্ধুও বাড়ায়। তাই নয় কী?

সোশ্যাল মিডিয়ায় বুঁদ হয়ে থাকা এই প্রজন্ম বন্ধুত্ব বোঝে না, সম্পর্ক বোঝে না বলে যে প্রচার এত দিন করা হয়েছে, এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেই ধ্যানধারণাও ভেঙে পড়ল। বরং এই আন্দোলন প্রমাণ করে দিল, এই প্রজন্মের বন্ধুত্ব ঠুনকো কোনো বন্ধুত্ব নয়।

এই আন্দোলন প্রমাণ করে দিল, এই প্রজন্মের বন্ধুত্ব ঠুনকো কোনো বন্ধুত্ব নয়।
ছবি: শুভ্র কান্তি দাস


আবারও আমাদের দেশ একদিন স্বাভাবিক হবে, ক্যাম্পাসগুলো খুলে যাবে। আমরা আবার ফিরে যাব আমাদের ক্লাসে, আমাদের হলে। যাদের আমরা হারিয়েছি, তারাও থাকবে—আমাদের আড্ডায়, গল্পে, স্মৃতিতে আর মধ্যরাতের নীরবতায়।
থাকবে তাদের রেখে যাওয়া শিক্ষাও।
পরের বন্ধু দিবসে আর কেউ বলবে না, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো বন্ধু হয় না। বরং সবাই জানবে, এ দেশে একটা আন্দোলন হয়েছিল। সেই আন্দোলনে এ দেশের বহু ছেলেমেয়ে বুক পেতে দিয়েছিল গুলির সামনে।
আর সেই গুলির মুখে কেউ তার বন্ধুকে ছেড়ে যায়নি। বরং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্লোগান দিয়েছিল, ‘বুকের মধ্যে ভীষণ ঝড়; বুক পেতেছি, গুলি কর।’