চুয়েটের জন্য ২০২৩ সাল কেন বিশেষ
চট্টগ্রাম শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে, সবুজ পাহাড়ের কোলে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ক্যাম্পাস। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে চার হাজার। তবে পুরোনোদেরও সঙ্গে নিলে চুয়েটের পরিবার অনেক বড়। ২০২৩ সাল নানা কারণেই বিশেষ হয়ে থাকবে এই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে। এ বছরের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি অর্জনের খবর জানাচ্ছেন তানবির আহমেদ চৌধুরী
৪ উদ্ভাবন
১. তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস কৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মেহেদী হাসান চৌধুরী ও প্রভাষক আদিত্য চৌধুরী সম্প্রতি একটি যন্ত্রের ধারণা দিয়েছেন, যার মাধ্যমে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশনের মতো রোগ নির্ণয় করা সম্ভব। বৈদ্যুতিক সংকেতের মাধ্যমে বিভিন্ন সূচক অনুসারে রক্তপ্রবাহের অস্বাভাবিকতা পর্যালোচনা করে এই যন্ত্র ৭৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ নির্ভুল ফল জানাতে পারে।
২. কলাগাছের আঁশ থেকে সাশ্রয়ী ও ক্ষতিকারক রাসায়নিকমুক্ত স্যানিটারি প্যাড তৈরি করেন চুয়েটের মেকাট্রনিকস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আসিফ আলম। আসিফের দাবি, কাপড়ের চেয়ে ৩০ গুণ বেশি শোষণ করতে পারে কলাগাছ। কলাগাছ থেকে তৈরি এই স্যানিটারি প্যাড।
৩. ট্রান্সফরমার চুরি ঠেকাতে একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেছেন যন্ত্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী মো. রফিক। এ যন্ত্রের সেন্সর ও মাদারবোর্ড ট্রান্সফরমারের গায়ে স্থাপনের পর কেউ ট্রান্সফরমার স্পর্শ বা ক্ষতির চেষ্টা করলেই ওই যন্ত্র থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ধারিত মুঠোফোন নম্বরে ফোন চলে যাবে। ইতিমধ্যে রফিকের উদ্ভাবিত যন্ত্রটি স্থানীয় এলএলপি প্রকল্পের (পীরগঞ্জের সাগুনী গ্রাম) ট্রান্সফরমারে স্থাপন করা হয়েছে।
৪. দেড় বছরের চেষ্টায় সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে বিজয়-৭১ নামে একটি গাড়ি তৈরি করেছে চুয়েট অটোমোটিভ ও মোবিলিটি সোসাইটি। তাঁদের তৈরি এই গাড়ি পরিবেশবান্ধব, জ্বালানিসাশ্রয়ী, বায়োডিজেলে পরিচালিত এবং স্বল্প ব্যয়ে তৈরি।
৪ পুরস্কার
১. ২০তম আর্কিটেক্টস রিজিওনাল কাউন্সিল এশিয়ায় (আর্কএশিয়ায়) ‘থিসিস অব দ্য ইয়ার’ বিভাগে রৌপ্য জিতেছেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ফাহিম আসহাব ফারুকী। ফাহিমের গবেষণার শিরোনাম ছিল ‘ইকোজ অব রিপ্লেনিশমেন্ট’, অর্থাৎ পরিপূরণের প্রতিধ্বনি। পদ্মা সেতু স্থাপনার জন্য নির্বাচিত এলাকাটি সেতু নির্মাণের পর কার্যকরভাবে ব্যবহার করাই ছিল গবেষণার মূল বিষয়।
২. জাপানি প্রতিষ্ঠান হোন্ডার ‘তরুণ প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানী পুরস্কার’ পেয়েছেন চুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ইফতেখার ইবনে জালাল। নবায়নযোগ্য শক্তি ও সবুজ প্রযুক্তি নিয়ে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে হোন্ডা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে তিনি পেয়েছেন ৩ হাজার মার্কিন ডলার। এ ছাড়া ৭ হাজার মার্কিন ডলার সম্মানীসহ ১০ সপ্তাহের বেশি শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ অথবা চার বছরের মধ্যে ১০ হাজার মার্কিন ডলার সম্মানীসহ স্নাতকোত্তর বা পিএইচডি করার সুযোগ পাবেন তিনি।
৩. গত ১৬ জুন বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্র্যান্টে (বিগ) বিজয়ী হয়ে ১ কোটি টাকার অনুদান পায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ডিজিটাল বিপণন প্রতিষ্ঠান মার্কোপোলো এআই, যার সহপ্রতিষ্ঠাতা চুয়েটের ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী তাসফিয়া তাসবিন। এ বছরই ‘ফোর্বস ৩০ আন্ডার ৩০ এশিয়া ২০২৩’ তালিকায়ও স্থান পেয়েছেন তিনি।
৪. ২ জুলাই একশনএইড ও দ্য ডেইলি স্টার আয়োজিত ক্লাইমেট জাস্টিস আইডিয়া কনটেস্ট ২০২৩-এর এনার্জি ট্রানজিশন বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয় চুয়েটের দল—সোলারজেন। আবাসিক গ্রাহক পর্যায়ে ‘নেট মিটারিং সিস্টেম টেকনোলজি’ বিশদভাবে আলোচনার জন্য প্রথম হয় তারা।
৪ উদ্যোগ
১. করোনাকালে জার্সি ও টি-শার্ট বিক্রি করতে শুরু করেছিলেন যন্ত্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ওয়াসিফ সাদমান। পরে টিউশনির জমানো টাকায় নিজস্ব উদ্যোগে টি-শার্টের একটি ফ্যাশন ব্র্যান্ড দাঁড় করান তিনি। নাম দেন আর্টটায়ার। সম্প্রতি স্টুডেন্ট স্টার্টআপ ক্যাটাগরিতে রাইজিং ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তানিম। তিনি জানালেন, এ বছর তিনি পোশাক খাত থেকে আয় করেছেন প্রায় ১৬ লাখ টাকা।
২. স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে রোবোটিকসের জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে ‘রোবট্রি’ বাংলাদেশ নামের একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছেন চুয়েটের পানিসম্পদ কৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম। এ উদ্যোগের জন্য এ বছর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় আয়োজিত বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্র্যান্টে ১০ লাখ টাকার অনুদান পেয়েছেন তিনি।
৩. অনলাইনে মাছ বিক্রি করেন যন্ত্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ইয়াদ হোসেন। তাঁর এ উদ্যোগের নাম ফিশারিও। পুকুর, নদী, সাগরের মাছ তো বটেই, সঙ্গে মাছের ডিম, শুঁটকি ও নানা ধরনের মাছসংক্রান্ত খাদ্যপণ্যও বিক্রি করেন ইয়াদ। আগামী বছর থেকে দেশের বাইরে রপ্তানি করার পরিকল্পনা তাঁর।
৪. উচ্চশিক্ষা হোক মাতৃভাষা বাংলায়—স্লোগানে তড়িৎকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ ফাহিম উদ্দিন ও নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষার্থী জেরিন সুলতানা গড়ে তুলেছেন ‘ইউনিক স্কুলিং’ নামের একটি শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম। বর্তমানে ২০ হাজারের বেশি প্রকৌশলের শিক্ষার্থী তাঁদের এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বাংলায় প্রকৌশলসংক্রান্ত নানা কোর্স করতে পারছেন।
বিসিএস, চাকরি, উচ্চশিক্ষায়ও সুখবর
বছরজুড়েই কর্মক্ষেত্রে ভালো অবস্থান ধরে রেখেছেন চুয়েটের শিক্ষার্থীরা। গত ৬ আগস্ট প্রকাশিত ৪১তম বিসিএসের ফলে দেখা যায়, বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে চুয়েটের ৬১ জন প্রাক্তন শিক্ষার্থী। এ ছাড়া ৯ সেপ্টেম্বর চুয়েটে এসে এখানকার যন্ত্রকৌশল বিভাগের চারজন শিক্ষার্থীকে প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগের জন্য নির্বাচন করে ইতালির বিখ্যাত স্টিল কোম্পানি—ডেনিয়েলি।
বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও এসেছে নানা সুখবর। সম্প্রতি চুয়েট ও নরওয়ের অ্যাডগার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যকার কেয়ার প্রকল্পের আওতায় শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে দুই বছরের জন্য চারজন এবং পাঁচ মাসের জন্য চারজন শিক্ষার্থী পাড়ি জমান নরওয়েতে। কেয়ার প্রকল্পের পরিচালক ও সমন্বয়ক অধ্যাপক আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম জানান, এ প্রকল্পের আওতায় চুয়েট থেকে মোট ৩১ জন শিক্ষার্থী নরওয়ে যাবেন।