কতশত মানুষ আমাকে বলেছিল, ‘তুমি পারবে না’

বিশ্বের অন্যতম বিলাসপণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান শ্যানেল–এর তিনি প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত গ্লোবাল সিইও (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা)। ইউনিলিভারের সঙ্গে কাজ করেছেন ৩০ বছর। প্রকৌশল নিয়ে পড়াশোনা করলেও দীর্ঘদিন সফলতার সঙ্গে মানবসম্পদ বিভাগে নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্ট্যানফোর্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব বিজনেসের সঙ্গে নেতৃত্ব, ব্যক্তিজীবন এবং ক্যারিয়ার ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন লিনা নায়ার। পড়ুন নির্বাচিত অংশ।

লিনা নায়ার
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

পেছন ফিরে তাকালে এখনো দেখতে পাই, কতশত মানুষ আমাকে বলেছিল, ‘তুমি পারবে না’, ‘কেউ কোনো দিন এটা করেনি’, ‘তোমাকে দিয়ে সম্ভব নয়’ ইত্যাদি। ভারতের পশ্চিমের খুব ছোট একটা শহরে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। মনে আছে, ছেলেবেলা থেকেই আমাকে অনেক আপসরফা করে বড় হতে হয়েছে। প্রথমে স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য, এরপর প্রকৌশলে পড়ার জন্য, বাড়ির বাইরে যাওয়ার জন্য। পথটা মসৃণ ছিল না। কারণ, আমার এলাকা থেকে এর আগে কোনো মেয়ে কোনো দিন প্রকৌশল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। তাই প্রথম হিসেবে আমাকে কিছুটা চাপ নিতে হয়েছে। সেই তখন থেকেই মা আমাকে বলতেন, ‘তুমি এত উচ্চাকাঙ্ক্ষী! কে বিয়ে করবে এমন মেয়েকে?’ এটাই ছিল মায়ের একমাত্র দুশ্চিন্তা—‘মেয়েকে কে বিয়ে করবে?’ কিন্তু আমি ওসব চিন্তা মাথায় নিইনি। এ জন্য অবশ্য আমাকে অনেক সহিষ্ণু হতে হয়েছে। অনেক সময়ই মজা করে বলি, ভীষণ মোটা চামড়ার মানুষ আমি। সেটা বোধ হয় আমার জন্য ভালোই ফল বয়ে এনেছে।

পদে পদে বাধার কারণেই সহনশীলতা বেড়েছে। চামড়া মোটা হয়েছে। আমি আত্মবিশ্বাসী হতে পেরেছি। এবং এই উপলব্ধি করেছি যে সুযোগ—হোক তা ছোট বা বড়, দুহাতে সাদরে গ্রহণ করে নিতে হয়। কখনোই কোনো সুযোগকে ছোট করে দেখার উপায় নেই। এমবিএ করার জন্য আমাকে প্রথমবারের মতো নিজের বাড়ি থেকে অনেক দূরে যেতে হয়েছিল। আমার বাড়ি কোলাপুর (মহারাষ্ট্র), আর আমার ক্যাম্পাস ছিল জামশেদপুর (ঝাড়খন্ড)। ট্রেনে করে বাড়ি থেকে ক্যাম্পাসে যেতে লাগত ৪৮ ঘণ্টা। এই দূরত্ব আমার মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে এক গ্রহ থেকে আরেক গ্রহে যাওয়ার শামিল। তাই এমবিএ করার সুযোগ পাওয়া আমার জন্য এক বিরাট প্রাপ্তি ছিল। এমবিএর সেই সুযোগকে আমি জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হিসেবে ধরে নিয়ে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম।

আরও পড়ুন

আমি বারবার নিজেকে মনে করিয়ে দিই, অনেক কিছুতেই আমার প্রথম হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে; কিন্তু আমিই যেন শেষ ব্যক্তি না হই। শেষ ব্যক্তি যে এই ফ্যাক্টরিতে কাজ করেছে, কোম্পানির শেষ নারী সিইও—এমন কিছু হতে চাই না। এই তাড়না থেকেই যা-ই করি, নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে আমার পেছনের অমসৃণ পথকে যতটা সম্ভব মসৃণ করার চেষ্টা করি। কঠিন পথকে পরের প্রজন্মের জন্য সহজ কীভাবে করা যায়, প্রতিনিয়ত ভাবি।

খুব ছোটবেলা থেকেই আমি যেখানে যাই, যে কাজই করি, আগে এর জন্য অনুপ্রেরণা খুঁজি। একজন পথপ্রদর্শক খুঁজি, পৃষ্ঠপোষক খুঁজি। এমন কাউকে খুঁজি যে আমাকে পথ দেখাতে পারবে, আমাকে সাহস জোগাতে পারবে। একবার পত্রিকায় এক কৃতি ছাত্রের খবর দেখে তাঁকে খুঁজে বের করেছিলাম। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, সে কীভাবে পরীক্ষায় প্রথম হলো, কীভাবে পড়াশোনা করেছে, তার কৌশলগুলো কী ছিল? এখনো আমি নতুন কিছু জানতে, নতুন কিছু শিখতে ঠিক তেমনটাই উদ্‌গ্রীব, যেমনটা ছোটবেলায় ছিলাম। শেখার ক্ষুধা আমার কখনোই মেটে না।

এত কিছু শেখার ভিড়ে আমাদের কিন্তু ব্যর্থ হতেও শিখতে হবে। জীবনে ব্যর্থতাকে গ্রহণ করতে পারা খুব জরুরি। আমি জানি, হার মেনে নেওয়া বা ব্যর্থতাকে গ্রহণ করতে বলা সহজ কিন্তু বাস্তবে ব্যর্থতা মেনে নেওয়া সত্যিই ভীষণ কঠিন। তবু বলছি, আমার ওপর ভরসা রাখো। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, কখনো কিছুতে হেরে গেলে, ব্যর্থ হলে, আগে দুদণ্ড সময় নাও। নিজেকে প্রবোধ দাও, ‘কী একটা শিক্ষা হলো!’ এরপর শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেকে সামলে নাও। আমি নিজে যখন কিছুতে ব্যর্থ হই, খুব রাগ হয় নিজের ওপর। হতাশ হয়ে পড়ি, কাঁদি। আমার খুব সহজেই কান্না চলে আসে। টয়লেটে গিয়ে মন ভরে কাঁদি, কান্না শেষে আবার স্বাভাবিক হয়ে বেরিয়ে আসি। কিন্তু এই ব্যর্থতা থেকে পাওয়া শিক্ষা কখনো ভুলি না। মন থেকে বলছি, একবার তুমি ব্যর্থতাকে গ্রহণ করে নিতে পারলে যেকোনো ধরনের ঝুঁকিই তুমি নিতে পারবে। কোনো ঝুঁকিতেই আর তোমার ভয় লাগবে না।

আরও পড়ুন