হামজার সঙ্গে কী কথা হলো

শুভেচ্ছা স্মারক হিসেবে বাংলাদেশি ফুটবল আলট্রাসের পক্ষ থেকে হামজার হাতে তুলে দেওয়া হয় একটি পতাকা।
ছবি: সংগৃহীত

‘জি জি, আমি তারারে চিনি। আমি তাদের সাথে দেখা খরবো,’ সিলেটি ভাষায় এভাবেই নাকি সম্মতি জানিয়েছিলেন হামজা চৌধুরী। আর সেটাই আনন্দে ভাসিয়েছে ‘বাংলাদেশি ফুটবল আলট্রাস’ নামের ফুটবল সমর্থকগোষ্ঠীকে। তরুণ এই ফুটবলপ্রেমীদের চাওয়া ছিল একটাই—সদ্য বাংলাদেশ দলে যোগ দেওয়া তারকা ফুটবলার হামজার সঙ্গে দেখা করা। তাঁদের চাওয়া পূরণ করেছেন হামজা। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হামজার সঙ্গে দলটির দেখা করার ছবি বেশ ভাইরালও হয়েছে। 
১৭ মার্চ দেশে এসেই হামজা গিয়েছিলেন তাঁর গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জে। গণমাধ্যমকর্মী ও ভক্তদের চাপে সেদিনই দেখা পাওয়া সহজ ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কীভাবে সুযোগ হলো? জানতে চাইলে বাংলাদেশি ফুটবল আলট্রাসের যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক হাসিব তালুকদার বলেন, ‘হামজা চৌধুরীর পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে আমরা যোগাযোগ করি। স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে বলা হয়েছিল, এখন তিনি দেখা করবেন না। পরে একটা টোকেনে নিজেদের পরিচয় জানাই। আমরা কারা, কোত্থেকে এসেছি—এসব সংক্ষেপে লিখে দিই। পরিচয় জানার পর হামজা চৌধুরী দেখা করার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেন।’
ইফতারের পর দেখা করার কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। ভিড় কমলে সাক্ষাতের সুযোগ পায় আলট্রাস। শুভেচ্ছা স্মারক হিসেবে বাংলাদেশি ফুটবল আলট্রাসের পক্ষ থেকে হামজার হাতে তুলে দেওয়া হয় একটি পতাকা।
ইউরোপের লিগে খেলা এই ফুটবলারের সঙ্গে দেখা করার মুহূর্তের বর্ণনা দেন হাসিব তালুকদার, ‘আমরা একটি ওয়েটিংরুমে অপেক্ষা করছিলাম। হামজা আসতেই সবাই উঠে দাঁড়াই। তিনি আমাদের দেখে প্রথমে সালাম দেন। জিজ্ঞাসা করেন, ভালো আছি কি না। এরপর বিভিন্ন কথার ফাঁকে একপর্যায়ে জানাই, “বিগত দিনে আপনার জন্য আমরা মাঠে তিফো (একধরনের ব্যানার) প্রদর্শন করেছি।” তিনি বলেন, “আমি এসব দেখেছি। আমি আপনাদের ভালোবাসি।”’
‘আপনাকে বরণ করার জন্য আমরা ঢাকা থেকে এসেছি’—জানানোর পর হামজা বলেন, ‘জি, আমার ওয়াইফ আপনারের ইতা ভিডিও করছে। সব আছে ভিডিওত।’ 

হামজা যেহেতু আগে থেকেই আলট্রাসদের ফলো করেন, তাই এ সাক্ষাৎকে তিনি স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছেন। তবে আলট্রাসের সদস্যদের কাছে এটা বিরাট ব্যাপার। হাসিব বলছিলেন, ‘আমরা রাত জেগে প্রিমিয়ার লিগের খেলা দেখি। সেই লিগের খেলোয়াড় এখন বাংলাদেশের হয়ে খেলবে—এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।’

‘আলট্রাস’ আসলে কারা 


ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবলে ‘আলট্রাস’দের উপস্থিতি ছিল অনেক আগে থেকেই। বিশেষ এই ভক্তরা খেলাটির সঙ্গে এমনভাবেই জড়িয়ে গেছেন যে আলট্রাস ছাড়া অনেক ক্লাবের কথা ভাবাই যায় না। 
‘আলট্রাস’ ইতালীয় শব্দ। ইংরেজি শব্দ ‘হুলিগান’–এর সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও শাব্দিক অর্থে বেশ ফারাক আছে। দুটোই ফুটবলের অন্ধভক্তদের (ফ্যানাটিক) প্রতিনিধিত্ব করে। তবে আলট্রাস বলতে সেই দলকেই বোঝানো হয়, যারা কিছুটা খ্যাপাটে, তবে সংগঠিত।
সাধারণত বিপক্ষ দল ও তাদের সমর্থকদের মানসিকভাবে কোণঠাসা করতেই তারা ভয়ংকর বেশে হাজির হয়। তাদের স্লোগানেও থাকে আক্রমণাত্মক সুর। আতঙ্ক ছড়ানোই লক্ষ্য। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকলেও ইউরোপের আলট্রাস সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে আলোচিত ও সমালোচিত। দলের প্রতি অতিরিক্ত আনুগত্য দেখাতে গিয়ে এই আলট্রাসের সদস্যরা অনেক সময় নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন। এমনকি প্রতিপক্ষ সমর্থককে রক্তাক্ত করার ঘটনাও ঘটেছে।
আলোচিত আলট্রাসদের মধ্যে রিয়াল মাদ্রিদের ‘আলট্রা সুর’, তুর্কি ক্লাব গালাতাসারাইয়ের ‘আলট্রাসলান’, ক্রোয়েশিয়ার ক্লাব দিনামো জাগরেবের ‘ব্যাড ব্লু বয়েজ’ অন্যতম।

বাংলাদেশের আলট্রাসদের যাত্রা 

মূলত বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি কাজী সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে ‘সালাহউদ্দিন হটাও’ আন্দোলনকে ঘিরেই ২০১৯ সালে পথচলা শুরু করে বাংলাদেশি ফুটবল আলট্রাস। করোনা-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে দল বেঁধে খেলা দেখে তারা। এর মাধ্যমে গ্যালারিতে প্রথমবারের মতো উপস্থিতি জানান দেওয়া হয়। বিশ্বের অন্য আলট্রাসদের মতো এই দলও নিজ দলের খেলোয়াড়দের অনুপ্রেরণা জোগানোর চেষ্টা করে। ভয় ঢোকায় বিপক্ষ খেলোয়াড়দের মনে। বাংলাদেশে মাত্র অর্ধযুগের যাত্রা হলেও আলট্রাস নামের সার্থকতা প্রমাণে নিয়মিত কাজ করছে তারা। 
সংগঠনটির মিডিয়া ম্যানেজার ইয়াছিন মোল্লা বলেন, ‘আমরা সাধ্যমতো কাজ করছি। তবে সবই প্রতিপক্ষ দলকে হারানোর জন্য। বাংলাদেশের জয় ছিনিয়ে আনার জন্য।’

ফুটবলের সুদিন কি ফিরছে

সংবাদমাধ্যমে একসময় প্রায়ই গ্যালারির শূন্য আসনের কথা উঠে আসত। ফুটবলে সেই অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে কি? বাংলাদেশি ফুটবল আলট্রাসের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান বলেন, ‘সেই শূন্যতা দূর করার লক্ষ্য নিয়েই আলট্রাস তৈরি।’ 
বর্তমানে অনেক তরুণেরই ইউরোপের ফুটবলেই আগ্রহ বেশি। খেলার মান এর পেছনে বড় কারণ। পাশাপাশি এই খ্যাপাটে সমর্থক দলের অংশ হওয়ার মধ্যেও একটা আনন্দ আছে। বাংলাদেশি আলট্রাসও ফুটবল মাঠে ইউরোপের মতো উন্মাদনা আনার চেষ্টা করছে। নব্বইয়ের দশকের মতো গ্যালারি যেন কানায় কানায় পূর্ণ থাকে—এটাই তাদের চাওয়া। ঘরোয়া ফুটবলের প্রতি তরুণদের আগ্রহী করতেও কাজ করছে আলট্রাস। মেহেদী হাসান বলেন, ‘নিজেদের কাজের মাধ্যমেই আলট্রাস সাধারণ দর্শকদের চেয়ে আলাদা। মানুষ আলট্রাসকে পছন্দ করাও শুরু করেছে। অনেকেই যুক্ত হচ্ছে কমিউনিটিতে।’ 
বর্তমানে বাংলাদেশে আলট্রাসের সদস্যসংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি। সদস্য হওয়ার আবেদনও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বিশ্বের বিখ্যাত আলট্রাসদের মতো বাংলাদেশ আলট্রাসও যেন বিশ্বে পরিচিতি পায়, সেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাঁরা।

আরও পড়ুন