ছবির মানুষটি আমার বাবা

লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্রী শ্রাবণী আক্তার

এই ছবিটিই ফেসবুকে দিয়েছেন লেখক

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিটা হয়তো আপনারা অনেকেই দেখেছেন। ‘মানবতার দোকান’ লেখা একটা বাক্স নিয়ে বসে আছেন একজন। দুই পাশে আরও দুটি বাক্স। একটার গায়ে লেখা—‘সামর্থ্য থাকলে দিয়ে যান’, অন্যটিতে লেখা, ‘প্রয়োজন হলে নিয়ে যান’। ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগের প্রশংসা করছেন অনেকেই।

ছবির মানুষটি আমার বাবা।

আমার বাবা আবদুর রহমান সরকার মুন্সিগঞ্জের ধলাগাঁও বাজার এলাকায় থাকেন। তিনি পেশায় ব্যবসায়ী। পাইকারি ব্যবসায়ী হিসেবে ওষুধ ও পোলট্রিসামগ্রী বিক্রি করেন তিনি। ৩ এপ্রিল আশপাশের মানুষের কষ্টের কথা ভেবে বাবা নিজের দোকানের সামনে একটা উন্মুক্ত দোকান চালু করেন। প্রথমদিকে বাবা আমাদের কাউকে বিষয়টি জানাননি। সাময়িক আগ্রহ থেকে অনেকেই তো অনেক কাজ করেন। কাজ ও পড়াশোনার সুবাদে আমি যেহেতু ঢাকায় থাকি, তাই বাবার কাজকর্ম খুব একটা দেখার সুযোগ পাই না। বাবার উন্মুক্ত দোকানের কথা শুনে তাঁর কাছে ছবি চাই। বাবা তো প্রথমে কোনো ছবিই দেবেন না। পরে অনেক অনুনয়ের পর দোকানের একটা ছবি আমাকে পাঠান।

খালি দোকানের ছবি দিয়ে কী হবে? আবারও অনেক অনুরোধের পর বাবা আমাকে নিজের ছবি পাঠান। দোকানের সামনে নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিসপত্র নিয়ে অপেক্ষা করছেন বাবা। বাজারে যাঁরা আসেন অথবা যাঁরা আর্থিক সংকটে ভুগছেন, তাঁদের পাশে থাকতেই বাবার এই উদ্যোগ। বাবার দোকানে অনেকেই সাহায্য দিয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেক অসহায় মানুষ নিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের প্রয়োজনীয় পণ্য। অন্য সব ক্রেতার মতোই তাঁদের সম্মান করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

৫ এপ্রিল নানা পণ্য নিয়ে দোকান শুরু করেন বাবা। সন্ধ্যাবেলা দোকানের অভিজ্ঞতা নিয়ে বাবার সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। পরে ‘বাবার কর্মকাণ্ড’ নামে ছবিটি আপলোড করি। আমার বাবার এমন উদ্যোগের খোঁজ পেয়ে বন্ধু ও ছোট-বড় অনেকেই বেশ প্রশংসা করছেন। বাবার কাজ দেখে আমিও মুগ্ধ হয়েছি। এক বন্ধু লেখেন, ‘কী সুন্দর! বাবার জন্য ভালোবাসা।’ আরেক বন্ধু লেখেন, ‘ওয়াও, আংকেল এত জোশ।’ আবার কেউ সম্মান জানিয়ে লেখেন, ‘দারুণ প্রচেষ্টা, কুর্নিশ জানাই আংকেলকে।’ আমার কাছে মনে হয় সবাই বাবার কাজকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিচ্ছেন। অনেকেই শুভকামনা জানিয়ে খুদে বার্তা পাঠিয়েছেন। অনেকেই সাহায্য-সহযোগিতায় যুক্ত হতে চেয়েছেন।

প্রথম দিন দোকানের কার্যক্রম সবাই ঠিক বুঝতে পারেনি। দোকানের আশপাশে ঘুরেফিরে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করেছে অনেকেই। পরের দিন থেকে একপ্রকার ভিড় লেগে গেছে। ইফতারের আগপর্যন্ত চলছে এই কার্যক্রম। সবাই যেন তার প্রয়োজনীয় জিনিস পায়, সে জন্য নাম লিখে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। এতে অসহায় কেউই বঞ্চিত হচ্ছে না। বাবার সঙ্গে এরই মধ্যে তাঁর বন্ধুবান্ধবদের অনেকেই যুক্ত হয়েছেন। বাবা যা করেন, মা সব সময় পাশে থাকেন। আমার ভাইও আমার পোস্ট শেয়ার করে মানুষের দোয়া চেয়েছেন। বড় বোন আর আম্মু সবাই বেশ খুশি এ ধরনের উদ্যোগে।

বাবার সঙ্গে লেখক

বাবা সব সময় ইতিবাচক কাজ করতে পছন্দ করেন। আমাদের তিন ভাইবোনকে ছোটবেলা থেকেই নানা কিছু শেখানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। অর্থের কষ্ট বোঝানোর জন্য বাবা একবার বাড়িতে রান্না ও খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বাবা চাইতেন, আমরা যেন বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা পাই। তখন আমি কলেজে পড়ি। দুষ্টু ছিলাম বলে কলেজ থেকে খেয়ে আসতাম। কিন্তু বাসায় বাবা রান্না করতে দেননি সেবার।

আমার বাবা সততা ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে যেকোনো কাজ করাকে উৎসাহ দেন। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার সময় আমি মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাইনি। মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু বাবা আমাকে সব সময় ভালো কিছু করার উৎসাহ দিয়ে গেছেন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে স্নাতক শেষে এখন স্নাতকোত্তরে পড়ছি। পাশাপাশি গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করছি একটি প্রতিষ্ঠানে। বাবার আদর্শেই আমি ভবিষ্যতে একজন গবেষক হিসেবে আরও উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিতে চাই এবং ভালো মানুষ হতে চাই।