সাবান থেকে সমুদ্র, যা কিছু তরুণদের বাতিলের খাতায়
সব সময়েই তরুণ প্রজন্মকে একটু বাঁকা চোখে দেখেছে তার আগের প্রজন্ম। কোনো কারণ ছাড়াই তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। বয়স চল্লিশের কোঠা পেরোলেই অনেকেই নাক উঁচু করে বলেছেন, ‘আমাদের সময়ে তো ডিমের দাম এত ছিল, টিভিতে অমুক প্রোগ্রাম হতো। মেন্টাল হেলথ, মি টাইম—এসব কিছু বুঝিনি বাপু! সেসব দিন কী আর আছে, সেই দিন বাঘের পেটে।’ এসব বলে বর্তমান সময়কে একটু ‘কম ভালো’ প্রমাণ করার চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেন না।
অথচ সময়ের সঙ্গী হয়ে চলার যে কোনো বিকল্প নেই। প্রতিটি যুগের আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। আর সব পরিবর্তনই যে খারাপ, তা-ও তো নয়। চলুন, এই সময়ের তরুণেরা; অর্থাৎ মিলেনিয়ালরা (যাঁদের জন্ম ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে) কী কী বাতিল করেছেন, মিলিয়ে নেওয়া যাক।
বদলে গেছে সকালের নাশতা
শহুরে তরুণদের সকালের নাশতায় ভাত, রুটি, খিচুড়ি বা সিরিয়ালের বদলে জায়গা নিচ্ছে চা, টোস্ট বিস্কুট, পাউরুটি, জেলি বা অ্যাভোকাডো টোস্ট। যেগুলো খেতে আপনাকে হাত ধুয়ে বসতে হয় না। আবার খাওয়ার পরও হাত ধোয়া বা প্লেট ধোয়ার প্রয়োজন নেই। মহামারিকাল সকালের নাশতার এই পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
গাড়ির কী দরকার?
তরুণেরা এখন আর গাড়ি কিনতে আগ্রহী নন; বরং উবারেই কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন। গাড়ি কেনা, লাইসেন্স করা, গাড়ির দেখভাল, ড্রাইভারের বেতন—এসবের চেয়ে বরং মোবাইলে উবার বা এ-জাতীয় কিছু কল করছেন। ব্যাস, অযথা ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কী? গাড়ি হয়ে উঠেছে প্রবীণদের বিলাসিতা।
সাবানের দিন শেষ?
এখানেও মূলত কলকাঠি নেড়েছে কোভিড। হাত ধোয়া বা গায়ে মাখার জন্য সাবানের চেয়ে হ্যান্ড ওয়াশ, স্প্রে বা বডি ওয়াশের কদর বেড়েছে বহুগুণ।
বিদায় টেলিভিশন
তরুণেরা টেলিভিশনকে একরকম টা টা বাই বাই করে দিয়েছেন। মিলেনিয়ালরা আপন করে নিয়েছেন হাতের মুঠোয় থাকা স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম। কেননা, যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার হলো। এখন দল বেঁধে সিনেমা দেখার চলও কমে এসেছে; বরং তরুণেরা শুয়ে-বসে একা মুঠোফোনেই দেখে ফেলছেন দুর্দান্ত সব সিরিজ। আর সেগুলো নিয়ে আলাপ করছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গ্রুপ বা হোয়াটসঅ্যাপে।
হু হু করে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে বিয়ে
পশ্চিমা তরুণ প্রেমিক-প্রেমিকারা একসময় অপেক্ষা করতেন, কখন আনুষ্ঠানিকতা শেষে পাদরি বলবেন, ‘নাউ ইউ মে কিস ইয়োর ব্রাইড।’ কিন্তু এখন আর বিয়েতেই আস্থা রাখছেন না তাঁরা। বিশ্বের নানা দেশে বিয়ের হার তো কমছেই, জন্মসংখ্যার হার রীতিমতো ‘নেগেটিভ’-এ চলে আসছে, ফলে তরুণ কর্মক্ষম ব্যক্তির অভাবে অর্থনীতি মন্দার মুখে পড়তে চলেছে। বিয়ে করে বাচ্চা নিলে সরকার থেকে ঘোষণা করা হচ্ছে নানা প্রণোদনা ও উপহার। তবু তরুণদের বিয়েতে আগ্রহী করা যাচ্ছে না।
কেবল পশ্চিমেই নয়, জাপান বা চীনেও একই অবস্থা। কেবল বিয়েই নয়, দীর্ঘ সময়ের রোমান্টিক সম্পর্ক বা কমিটমেন্টই আগ্রহী করছে না তরুণদের। তাঁরা বরং ঝুঁকছেন অ্যাপে পছন্দ করা সঙ্গীকে নিয়ে কফি শপে আড্ডা, এক দিনের ডে আউট। কিংবা মুঠোফোনের খুদে বার্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখছেন সম্পর্ক।
কমেছে হিরের কদর
এখনকার তরুণেরা লাখ টাকা দিয়ে হিরের একটা আংটি কেনার চেয়ে বরং সেই টাকা দিয়ে একটা ট্যুর করে আসতেই বেশি আগ্রহী। কেবল হিরেই নয়, সোনা, রুপা বা প্লাটিনাম—মোদ্দাকথা অলংকারেরই কদর কমেছে।
ডিজাইনার’স ড্রেস কে পরে!
নব্বইয়ের দশকে দারুণ জনপ্রিয়তা পায় ডিজাইনার’স ড্রেস। এর পর থেকে সেই জনপ্রিয়তার পারদ প্রতিবছর কেবল হু হু করে বেড়েই চলেছিল। কয়েক বছর হলো, তরুণেরা পোশাকের প্রতি তেমন একটা সিরিয়াসনেসই দেখাচ্ছেন না। দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে স্ট্রিট ফ্যাশন ও বোহো ফ্যাশন (যাযাবর ফ্যাশন)। পুরোনো পোশাক আপসাইকেল করার চলও বেড়েছে। তরুণেরা মার্সিডিজ থেকে নেমে রাস্তা থেকে কাপড়চোপড় কিনছেন, এমন দৃশ্যও সাধারণ হয়ে উঠছে। এখানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে মহামারিকাল।
সাগরে যান নতুন দম্পতিরা
কয়েক দশক আগেও বেড়াতে যাওয়ার জন্য সাগর ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল। তবে সময়ের সঙ্গে ট্যুরিজমে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ছুটি কাটানোর জন্য নিরিবিলি কোনো রিসোর্ট-ই সই। আর বেড়ানোর জন্য প্রত্যন্ত গ্রাম, পাহাড়, জঙ্গল, মরুভূমি, সমতল, নদী, শহুরে স্থাপনা, পাঁচ তারকা হোটেলই বেশি টানছে। ক্রুজ নাকি তেমন রোমাঞ্চকর নয় তরুণদের কাছে। জাদুঘর, শপিং মল, রাস্তাঘাট বা কোনো একটা নির্জন কফি শপও হয়ে উঠছে বেড়ানোর জায়গা। এখন নাকি সাগরে যান কেবল নতুন দম্পতি, আর সিনেমার শুটিংয়ের দল।
কমছে জিমের সংখ্যা
এখনকার তরুণেরা নাকি সিক্স প্যাক বা জিম বডি বানাতে আগ্রহী নন; বরং যোগব্যায়াম, হাঁটা, দৌড়ানো, সাঁতরানো, সাইকেল চালানো বা ঘরে ট্রেডমিলে ঘাম ঝরানোতেই বেশি আগ্রহী তাঁরা।