ভাইবোনের মধ্যে একজন হয়তো সাফল্যে পিছিয়ে, তাঁকে অবহেলা করছেন না তো?
টানা বিছানায় এ-ওর গায়ে পা তুলে ঘুমানো। হাত ধরাধরি করে স্কুলে যাওয়া, বাড়ি ফেরা। ভাতের সঙ্গে মাছের ঝোল মেখে খাওয়াও তো একসঙ্গে। এভাবে মাখামাখি করে করেই তো বড় হয় ভাইবোনেরা। কলেজে পা দিয়ে জগৎটা বড় হতে হতে বন্ধনটা একটু আলগা হতে থাকে যেন। তখন আর আমভর্তা, জামভর্তাটুকু কাড়াকাড়ি করে খাওয়ার সময় মেলে না। রোজ বিকেলে পাড়া কাঁপিয়ে খেলাধুলা, খুনসুটিও একসঙ্গে হয়ে ওঠে না। তখন সময়গুলো অনেকটাই ছিনিয়ে নেয় বন্ধুরা। জীবনে আসা বিশেষ মানুষগুলো। তবু গোপন ব্যথা যখন বুকে লাগে, গলায় কান্না দলা পাকিয়ে ওঠে তখন সেই ভাই বা বোনের বুকে মুখ গুঁজেই কেঁদে ফেলা যায়। বলে ফেলা যায় নিজের বোকা বোকা প্রেমের গল্প।
সময় আরও বয়ে যায়। ভাইবোনদের জগৎটা আরও বদলে যায়। কেউ বিত্তবান হয়ে ওঠেন। কেউ হয়তো কষ্ট করে জীবনটা চালিয়ে নেন। মা-বাবার কথা শুনে চলা লক্ষ্মী মেয়েটি হয়তো জীবনে বেশি সফলতা পেয়ে যায়। আর অবাধ্য ছোট ভাইটি হয়তো চাকরির সোনার হরিণের খোঁজে। বোনটি হঠাৎ একদিন টের পায় চাইলেই আর আদরের ভাইয়ের কান টেনে ধরা যায় না। ভাইবোনের মিষ্টি সম্পর্কে শুধু দূরত্বই আসে না, চলে আসে তিক্ততা। কখনো সেটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়। এমনও হয় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না। অভিমান বুকে নিয়ে হয়তো পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় একজন। দেখা হয় না, ছোঁয়া হয় না, কথা হয় না।
ভাইবোনের মধ্যে কেন এমন দূরত্ব চলে আসে? কাজলা দিদির মতো যে বড় বোন কোলের কাছে না থাকলে রাতে ঘুম আসত না, যে বড় ভাইটির সাহস না পেলে খেলার মাঠে ঝড় তোলা যেত না, কেন তাঁর সঙ্গে সম্পর্কে দেয়াল তৈরি হয়? শোনা যাক এমন এক দূরত্বের ঘটনা।
মফস্সল এলাকার এক পরিবারে পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে ছোট ভাইটি ছিল সবার আদরের। একটু চুপচাপ সে। নিজের সব প্রয়োজন মুখ ফুটে বলত না। সেই নীরবতা পুষিয়ে দিত অন্য ভাইবোনেরা। চার ভাইবোন মিলে আগলে রাখত ছোট ভাইটিকে। একে একে বড় ভাইবোনদের বিয়ে হয়ে যায়। টানাপোড়েনের সংসার থেকে তাঁরা চলে যান সচ্ছলতার দিকে। মফস্সল ছেড়ে কেউ চলে যায় রাজধানীতে, কেউ বিভাগীয় শহরে। গ্রামে পড়ে থাকে ছোট ভাইটি। একটা সময় বড় ভাইবোনের সঙ্গে তার সম্পর্কটা হয়ে যায় দাক্ষিণ্যের। নিয়মিত আর্থিক সাহায্য দিয়ে যাওয়া বড় ভাইটি হয়তো বলে ফেলেন, ‘এভাবে কত দিন চলবে?’ অভিমান জমতে থাকে ছোট ভাইয়ের মনে। মাকেও আর আগের মতো আপন মনে হয় না। বড় ভাইবোনেরা এলে মায়ের বাড়তি যত্ন বেশি করে চোখে পড়তে শুরু করে। ভাইবোনদের সচ্ছলতায় ছোট ভাইটির প্রত্যাশাও বাড়তে থাকে। মনে হতে থাকে, তারা তো চাইলে আরেকটু পাশে দাঁড়াতে পারে। এভাবেই শুরু হয় তিক্ততা। অভিমান, রাগ, ঈর্ষা, করুণা, সমালোচনা—সব মিলে সম্পর্কে বরফ জমতে থাকে। একসময় সবার সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ হয়ে যায়। ছোট ভাইটি আরও নীরব হয়ে যায়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও মনোবিদ তানজির আহমেদ বলছেন, এ ধরনের সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে। শৈশব থেকেই মা-বাবার আচরণে ভাইবোনদের মধ্যে সমস্যার বীজ ঢুকে যেতে পারে। ছেলেমেয়েদের বেড়ে ওঠার সময় মা-বাবার মধ্যে পক্ষপাত না থাকাটা খুব জরুরি। পরিবার, আত্মীয়স্বজনের মধ্যে আর্থিক, পেশাগত অবস্থানকে গুরুত্ব না দিয়ে গুরুত্ব দিতে হবে সম্পর্ককে। শৈশব থেকে কেউ যদি পরিবারে এই রীতি দেখে বড় হয়, তাহলে পরে এটা নিয়ে সমস্যা অনেকটাই কমে যায়। কোনো সন্তান যদি দেখে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাবা, কর্মস্থলে আসা গ্রামের কৃষক বড় ভাইকে দেখে সসম্মানে উঠে দাঁড়ান, তাহলে সেও একই মনোভাব নিয়ে বড় হবে।
আর্থিক সচ্ছলতা আর পেশাগত জীবনের ছাপ পড়েছিল দুই বোনের জীবনে। শোলক-বলা কাজলা দিদি যখন সফল ব্যাংকার, তখন আদুরে ছোট বোনটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কম মাইনের চাকরিজীবী। গলা ধরে দুই বোনের না-ফুরানো গল্পগুলো এখন হঠাৎ করেই ফুরিয়ে যায়। বড় বোন যখন ফ্ল্যাট বা গাড়ি কেনার গল্প বলে, ছোট বোনটি তখন চিন্তা করে রাতের রান্নাটা কত অল্প খরচে করে ফেলা যায়। বড়টি যতই ছায়া দিয়ে রাখতে চায়, ছোটটির আত্মসম্মান তাতে বাদ সাধে। মা-বাবার ঘরে ফিরলেও আর ফেরা হয় না আগের মতো। ছোটটি ভাবে, মা-বাবা সফল বোন ও তাঁর স্বামীকে বেশি গুরুত্ব দেন। অভিমানে গুটিয়ে থাকে সে। বড়টি চাইলেও সেই আগের দিনের মতো ‘আড়ি আড়ি, ভাব ভাব’ করতে পারে না। কত বছর আগে মান্না দের গাওয়া ‘সে আমার ছোট বোন, বড় আদরের ছোট বোন’ গান মন খুলে গাইতে পারে না।
সব সময় যে ভাবনাগুলো অভিমান থেকে হয়, তা-ও না। আশাপূর্ণা দেবীর উপন্যাস সুবর্ণলতা-তে যেমন দেখা যায়, পরিবারের যে মেয়েটির স্বামী বেশি দরিদ্র সে এলে মায়ের মুখটিও গোমড়া হয়ে যায়। মায়ের বাড়িতে বেশি দিন থাকতে চাইলে বলে ওঠেন, অত দিন থেকে কাজ নেই। তপন সিংহ পরিচালিত গল্প হলেও সত্যি সিনেমায় পরিবারের অনাথ নাতনি কৃষ্ণা অনেকটা গৃহকর্মীর মতো থাকে। ছোট কাকার চরিত্রে অভিনয় করা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় সবার জন্য সিনেমার টিকিট কেনার পরিকল্পনার সময় তার কথা ভুলে যান। বলে ওঠেন, ‘সত্যি ও যেন একটা ফেলনা। ওর কথা মনেই থাকে না।’
ভাইবোনের মধ্যে এ রকম টানাপোড়েন সামাজিক পটভূমি ও পরিমণ্ডলে বিবেচনা করা দরকার বলে মনে করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সুলতানা মোস্তফা খানম। তিনি বলেন, ‘কারও সাফল্যকে দেখতে হবে পারিবারিক পরিমণ্ডলে। অর্থাৎ ভাই বা বোনের সাফল্য মানে পরিবারের সাফল্য। ভাবতে হবে তাতে আমারও সাফল্য, আমারও আনন্দ। আবার যিনি বেশি সফল, তাকে মনে রাখতে হবে পটভূমি। ভাইকে মনে রাখতে হবে, এই সাফল্যের পেছনে ওই ভাই বা বোনটিরও অবদান রয়েছে।’
ভাই বা বোনের অবস্থানের সঙ্গে তুলনায় না গিয়ে সেটিকে নিজের পরিবারের কাছে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরার সুন্দর উদাহরণ দেন অধ্যাপক সুলতানা মোস্তফা খানম। কম সফল বড় ভাই হয়তো তাঁর সন্তানদের বলতে পারেন, ছোট চাচা পরিশ্রম করেছেন দেখেই জীবনে উন্নতি করছেন। সন্তানদের তিনি তাঁর মতো হতে উৎসাহ দিতে পারেন। আবার সুপ্রতিষ্ঠিত ছোট ভাই তার সন্তানদের হয়তো বড় ভাইয়ের অন্য কোনো গুণের কথা তুলে ধরতে পারেন পরিবারের সামনে। সেটা হতে পারে তাঁর পরোপকার, ভালো গান করা বা ছবি আঁকা। এভাবে পারস্পরিক সম্মানবোধে সম্পর্কের বন্ধন শক্ত হয়।
সমাজের নিয়মে একসুতোয় বাঁধা ভাইবোনেরা একসময় আলাদা সুতা বোনে। গড়ে ওঠে আলাদা পরিবার। অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থান, জীবনযাপনে থাকে বৈচিত্র্য। সহজভাবে মেনে নিলে, মানিয়ে নিতে পারলেই সম্পর্কগুলোর বুনন সহজ হয়। হয়ে ওঠে নকশিকাঁথার রঙিন গল্প।