আবু সাঈদের এই প্যান্টটা মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছিল, মুগ্ধর পরিচয়পত্রটা রক্তমাখা
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান নিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে চলছে প্রথম আলোর বিশেষ প্রদর্শনী ‘জুলাই-জাগরণ’। সেখানে প্রদর্শিত হচ্ছে শহীদদের ব্যবহৃত নানা স্মারক। এখানে রইল ছয়টি স্মারকের গল্প।
আবু সাঈদের প্যান্ট
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ১৬ জুলাই এক হাতে লাঠি নিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়েছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। এ সময় একের পর এক তাঁর গায়ে আঘাত হানে রাবার বুলেট। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাস্তায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন সাঈদ। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিলে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়। সাঈদের গায়ের টি-শার্টটি হাসপাতালেই খুলে ফেলা হয়। ১৭ জুলাই তাঁর দাফনকাজের পর পরনের প্যান্টটা মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছিল। পোশাকটির গুরুত্ব বুঝতে পেরে পরিবারের পক্ষ থেকে তুলে তা সংরক্ষণ করা হয়। এই প্যান্টসহ আবু সাঈদের ব্যবহৃত বেশ কিছু স্মারক প্রদর্শনীতে ঠাঁই পেয়েছে।
মুগ্ধর রক্তমাখা পরিচয়পত্র
পানি লাগবে কারও? পানি, পানি—বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গত ১৮ জুলাই এই বলে রাজধানীর উত্তরার আজমপুর এলাকায় ক্লান্ত শিক্ষার্থীদের মধে৵ পানি বিতরণ করছিলেন মীর মাহফুজুর রহমান (মুগ্ধ)। তাঁর গলায় ঝুলছিল বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) আইডি কার্ড বা পরিচয়পত্র। কিছুক্ষণ পর আজমপুরের সড়কে তাঁর গুলিবিদ্ধ দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। লেমিনেটিং করা আইডি কার্ডের ভেতরেও রক্ত ঢুকে পড়েছিল। রক্তমাখা কার্ডটি সেভাবেই রেখে দিয়েছে মুগ্ধর পরিবার। আরও রেখেছে তাঁর ব্যবহৃত নানা জিনিস।
নাঈমার আঁকা শেষ ছবি
নাঈমা সুলতানা ছবি আঁকতেন। বিভিন্ন চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় ছিলেন নিয়মিত মুখ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় আঁকার খাতায় রং আর পেনসিলে মূর্ত হয়ে ওঠে প্রতিবাদের ভাষা, তারপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপে তা পোস্ট করে। ১৯ জুলাইয়েও নিজের ঘরে বসে আঁকছিলেন আন্দোলনের ছবি। আঁকতে আঁকতেই মাকে বললেন, শুকনা কাপড় আনতে বারান্দায় যাচ্ছি। মেয়ের পেছন পেছন মা-ও গেলেন। বারান্দায় যেতেই একটা গুলি এসে নাঈমার মাথায় ঢুকে যায়। অসমাপ্ত থেকে যায় কলেজছাত্রী নাঈমার শেষ ছবি।
সৈকতের ব্যাট আর বল
মাহমুদুর রহমান সৈকত ছিলেন ক্রিকেটপাগল তরুণ। ফুরসত পেলেই মোহাম্মদপুরের বাসার সামনের গলিতে ক্রিকেট খেলতেন। সংগ্রহ করেছিলেন নানা আকারের ব্যাট। ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) পড়ার ইচ্ছাও ছিল। নানা কারণে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। শুধু ক্রিকেটই নয়, ফুটবল, ব্যাডমিন্টনসহ নানা খেলাতেই ছিলেন পারদর্শী। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় গত ১৯ জুলাই রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের সড়কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সৈকত। সরকারি মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছিলেন মাহমুদুর রহমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সাত কলেজের ভর্তি পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
আহনাফের গিটার
একটা গিটারের খুব শখ ছিল। ধীরে ধীরে টাকা জমাচ্ছিলেন। অবশেষে ২০২৩ সালে ঈদসালামি পেয়ে হয়ে গেল গিটার কেনার টাকা। শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফকে এবার আটকায় কে! সোজা চলে গেলেন গিটারের দোকানে। গিটারসহ আরও কিছু মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট কিনে নিয়ে এলেন বাড়ি। তারপর ইউটিউব দেখে দেখে প্লাগ ইন, নিজে নিজেই সুর তোলা। ৪ আগস্ট মিরপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার মাত্র কয়েক দিন আগে পরিবারের সদস্যদের গিটার বাজিয়ে শুনিয়েছিলেন আহনাফ। বেসুরো বলে খুনসুটি করলেন খালা, শেষ পর্যন্ত খালাকেই গাইতে হলো গিটারের তালে তালে। আহা, এই গিটারের তারে আর কোনো দিন পড়বে না আহনাফের আঙুলের ছোঁয়া।
জাবিরের সাইকেল
জাবির ইব্রাহীমের চাচার কোনো ছেলেপুলে নেই। ভাইয়ের ছেলে জাবিরকে ঘিরেই ছিল তাঁর যত আদর–আহ্লাদ। জাবিরের মৃত্যুর মাসখানেক আগে তাকে এই সাইকেলটা কিনে দিয়েছিলেন তিনি। সাইকেল পেয়ে ছোট্ট জাবিরের সে কী আনন্দ! বায়না ধরল, বড়দের মতো সে–ও রাস্তায় সাইকেল চালাবে। কিন্তু বাড়ির সামনের রাস্তাটা যে খানাখন্দে ভরা। বাড়ির গ্যারেজেই তাই সাইকেল চালাত জাবির।
৫ আগস্ট উত্তরার জসীমউদ্দীন সড়কে মা-বাবার সঙ্গে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে বিজয় মিছিল দেখছিল জাবির ইব্রাহীম। সেখানেই গুলিবিদ্ধ হয় ছোট্ট ছেলেটি।