ফাদার রিগনের ডায়েরিতে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিনগুলো
১৯৭১ সালে গোপালগঞ্জের বানিয়ারচরে গির্জার দায়িত্বে ছিলেন ফাদার মারিনো রিগন। ডায়েরিতে যুদ্ধদিনের নানা ঘটনা টুকে রাখতেন এই ইতালীয় যাজক। সেই ডায়েরি এখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এই বাংলাদেশপ্রেমী ফাদারের জন্মশতবর্ষে তাঁর ডায়েরি থেকে মুক্তিযুদ্ধের শুরুর কয়েকটি দিনের বর্ণনা ইংরেজি থেকে বাংলায় তুলে ধরেছেন রাসেল মাহ্মুদ
২৪.৩.৭১
মাছ ধরার ট্রলারে করে খুলনাযাত্রা স্থগিত করলাম। বুঝতে পারছিলাম, পরিস্থিতি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। সারা বাংলাদেশ থেকেই শোনা যাচ্ছিল, ‘জয় বাংলা, জয় বাংলা!’
২৯.৩.৭১
বাইরে থেকে এখনো অনিশ্চিত সব খবর আসছে। আজ কোনো লঞ্চ আসেনি, না খুলনা থেকে, না ঢাকা থেকে। বাঙালিরা বাড়িতে বাড়িতে আর জেলেরা উঁচু একটি বাঁশের খুঁটিতে আমাদের লঞ্চে বাংলাদেশের পতাকা এবং কালো পতাকা উত্তোলন করেছে। আমরা সবাই আবেগাপ্লুত, আমাদের চোখে জল।
৪.৪.৭১
আমাদের জেভেরিয়ান ফাদার মারিও ভেরোনেসিকে দুই পাকিস্তানি সেনা আজ মেরে ফেলেছে। যদিও খবরটা পেতে আমাদের বিলম্ব হয়েছে। খুলনা থেকে অনেকগুলো পরিবার এসেছে।
৫.৪.৭১
আজ নদীর স্রোতে কয়েকটা লাশ ভেসে গেছে। লোকে বলাবলি করছিল, ওগুলো পাঞ্জাবিদের লাশ। পালিয়ে ঢাকায় যেতে চেয়েছিল ওরা, কিন্তু টেকেরহাটে ধরা পড়ে যায়। তাদের শিরোচ্ছেদ করা হয়। পাকিস্তান রেডিও অব্যাহতভাবে প্রচার করে যাচ্ছিল, পূর্ব পাকিস্তান শান্ত, স্বাভাবিক আছে।
৭.৪.৭১
খুলনা থেকে অব্যাহতভাবে আসছে বাস্তুহারা মানুষ।
১১.৪.৭১
নীরবে কেটে গেল ইস্টার সানডে। বানিয়ারচরে এখনো আমি একা। কারণ, ফাদার পিটার কলম্বারা এখনো ফেরেননি। কালীগ্রামে লোকেরা আজ জানাল, পাকিস্তানিরা আমাদের একজন ক্যাথলিক পুন্না ফোলিয়াকে মেরে ফেলেছে। জেলেদের আমাদের লঞ্চ থেকে বাংলাদেশের পতাকা নামিয়ে ফেলতে বললাম। গ্রামে এসে পাকিস্তানি সৈন্যরা যদি মিশন আর গির্জার ঠিক সামনে বাংলাদেশের পতাকা দেখতে পায়, তাহলে সেটা হবে মর্মান্তিক।
২২.৪.৭১
বেলা দুইটার দিকে দুটি পাকিস্তানি জেট বিমান বানিয়ারচরের ওপর দিয়ে এসে নদীর তীরে নোঙর করা লঞ্চগুলোর ওপর গুলি চালাতে শুরু করে। একটা লঞ্চের ইঞ্জিনেও কয়েকটা গুলি লাগে। মানুষজন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। গুলিবিদ্ধ হন পাঁচজন, একজনের অবস্থা গুরুতর। লোকজন পালাতে শুরু করেছে। জালিরপাড়ে আজ কোনো হাট বসেনি। পাকিস্তানি রেডিও অব্যাহতভাবে প্রচার করে যাচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানে সবকিছু শান্ত আছে।
২৫.৪.৭১
ভাঙ্গা ও দিগনগরের দিকের আকাশে আজ ধোঁয়া উঠতে দেখলাম। সেই ধোঁয়া নিয়ে অনেক গল্পই শোনা গেল: বস্তা, লুটপাটের জন্য গ্রাম ছেড়ে দেওয়া, হিন্দুদের মৃত্যু ইত্যাদি; কিন্তু পরে আমরা জানতে পারলাম, আসলে একটি ইটের স্তূপ জ্বলছিল। কিন্তু তার পর থেকে সত্যিই এসব ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই বানিয়ারচরের আশপাশে ঘটতে থাকল। পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রতিদিন গ্রামে গ্রামে গিয়ে লুটপাট চালাত, কুঁড়েঘরে আগুন দিত, বিশেষ করে হিন্দুদের হত্যা করত। সন্ধ্যায় আকাশে সূর্যাস্তের মতো করুণ লাল আভা দেখতে পেতাম।
২৬.৪.৭১
টেকেরহাট থেকে একজন এসে আমাদের নিশ্চিত করল, সত্যিই পাকিস্তানি সৈন্যরা টেকেরহাটে এসে বাঙালিদের সঙ্গে নিয়ে লুটপাট করছে।
৩০.৪.৭১
আজ বিকালে গোপালগঞ্জের দিকে ধোঁয়া ও আগুনের শিখা দেখা গেছে। সম্ভবত পাকিস্তানি সৈন্যরা সাতপাড়া বাজার লুট করছে।