বিদেশি শিক্ষার্থীরা কেন বাংলাদেশে পড়তে আসছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা কেমন
ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, দক্ষিণ সুদান, চীন, জাপান, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, গাম্বিয়া, নাইজেরিয়াসহ নানা দেশ থেকে বিদেশি শিক্ষার্থীরা পড়তে আসছেন বাংলাদেশে। কেন তাঁরা উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ বেছে নিলেন? এ দেশে তাঁদের অভিজ্ঞতাই বা কেমন? শুনুন তাঁদের মুখেই
সবাই খুব অতিথিপরায়ণ
লাভরাজ আচার্য, নেপালের নাগরিক, দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগের শিক্ষার্থী
উচ্চমাধ্যমিকের পর আমার দেশ নেপালের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি হতে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। কিন্তু সুযোগ পাইনি। পরে আমার দুজন বন্ধু, যারা এখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত, আমাকে বাংলাদেশে আসার পরামর্শ দেয়। তাদের কাছ থেকে এখানকার ব্যবহারিক শিক্ষার ব্যাপারে জেনেই আগ্রহী হই। পাশাপাশি এখানে খরচও কম। ফলে আসার ব্যাপারে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি।
কিন্তু এখানে আসার পর শুরুর দিকে ভাষা নিয়ে কিছুটা অসুবিধা হতো। বিশেষ করে চলাফেরা করতে। কিন্তু এখন আর সেই সমস্যাটা নেই। যদিও এখানকার অতিরিক্ত তৈলাক্ত ও ঝাল খাবার খেতে আমার এখনো সমস্যা হয়। তবে এখানকার মানুষ ও শিক্ষার্থীরা অনেক অতিথিপরায়ণ। শিক্ষকদের কথা আলাদা করে বলতে চাই। তাঁরা খুব যত্নের সঙ্গে পড়ান। সব সময় অনুপ্রাণিত করেন। বিশেষ করে বিদেশি শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁরা আলাদা মনোযোগ দেন।
এখানকার আন্তর্জাতিক বিষয়ক দপ্তর শিক্ষার্থীদের নিয়ে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আমাদের সুবিধা-অসুবিধা জানতে চায়, বিষয়টি আমার ভালো লাগে। আমি অবশ্যই আমার দেশের শিক্ষার্থীদের এখানে আসার কথা বলব। প্রয়োজনে যেকোনো সহযোগিতাও করব, যেভাবে আমার বন্ধুরা আমাকে করেছে।
রোগী দেখতে দেখতেই বাংলা শিখেছি
তুবা আসিফ, পাকিস্তানের নাগরিক, ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী
খোঁজখবর নিয়ে জানতে পেরেছিলাম, বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা বিশ্বজুড়েই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছেন। এখানকার মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই বাংলাদেশ সরকারের সার্ক কোটা বৃত্তি নিয়ে পাকিস্তানের পাঞ্জাব থেকে এ দেশে পড়তে আসি ২০২১ সালে। সেই থেকে জীবন চলছে রোলার কোস্টারের মতো। সময় কাটছে ভীষণ ব্যস্ততায়।
হাসপাতালের ওয়ার্ডে রোগী দেখতে দেখতেই অনেক কিছু শেখা হয়ে যায়—এই বিষয়টাই আমার কাছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক। মজার ব্যাপার হলো, ওয়ার্ডে রোগী দেখতে দেখতেই আমি বাংলা শিখেছি। হোস্টেলে থাকা-খাওয়া নিয়ে অবশ্য কিছু সমস্যায় পড়তে হয়েছে, যানজটের কারণে চলাফেরায় ভোগান্তিও আছে। তবে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে একটা কথা বলতেই হয়, এখানকার ভেলপুরি দারুণ! নানা রকম মাছ আর ফলও সুস্বাদু। তবে ভিন্ন পরিবেশ আর ভিন্ন সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা যে কারও জন্যই এখানে মানিয়ে নেওয়াটা একটু কষ্টকর।
বাড়ি যাওয়ার সরাসরি ফ্লাইট নেই। দীর্ঘ ট্রানজিট। বছরে একবারের বেশি যাওয়া হয় না। এ দেশে আমার পূর্বপরিচিত কেউই নেই। কিন্তু তাতে কি? এখানে আমি অসাধারণ কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। নতুন বন্ধুরা এখানে আমার জীবনটাকে রঙিন করে তুলেছে। আর আমার রুমমেটের পরিবার তো আমার নিজেরই পরিবার হয়ে উঠেছে। এই মানুষগুলোর ভালোবাসা সত্যিই মুগ্ধ করে।
বাংলাদেশে সময়টা উপভোগ করছি
কেজাং ওয়াংমো, ভুটানের নাগরিক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী
সত্যি বলতে এখানকার গরম আবহাওয়া আর স্ট্রিট ফুডের বৈচিত্র্য ছাড়া বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন কিছু জানতাম না। উচ্চমাধ্যমিকের পর এখানকার শিক্ষার পরিবেশ সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়। তখন আমাদের রানি মাতা জেতসুন পেমার নামে একটি সরকারি বৃত্তি পাই। মূলত এই বৃত্তির মাধ্যমেই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। যেহেতু ভুটান থেকে বাংলাদেশের দূরত্ব বেশি নয়, তাই এখানে আসার সিদ্ধান্ত নিতে খুব একটা ভাবতে হয়নি।
এখানে আসার পর ভাষা নিয়ে খুব ভয়ে থাকতাম। বিশেষ করে বাইরে যখন যেতাম। তবে আস্তে আস্তে ভয় কেটে গেছে। কেননা ভুটানিদের অনেকেরই হিন্দি ও নেপালি ভাষায় মোটামুটি একটা দখল থাকে। বাংলার সঙ্গে যার কিছুটা হলেও মিল আছে। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যদিও সাংস্কৃতিক দিক থেকে ভুটানের সঙ্গে এখানকার পার্থক্য অনেক। তারপরও এখন আমরা মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
ব্র্যাকের সার্বিক সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে আলাদা করে বলতেই হয়। এখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তারা সবাই আমাদের সহযোগিতা করেন। আমাদের আন্তর্জাতিক অফিস রয়েছে, যেকোনো প্রয়োজনে তাঁরা দিকনির্দেশনা দেন। যখনই আমাদের কোথাও যেতে হয়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গাড়ি দিয়ে দেয়। এটা একটা বড় সুবিধা।
আমি ছোটবেলা থেকেই স্বেচ্ছাসেবক হতে চেয়েছি। জলবায়ু ও পরিবেশসংক্রান্ত প্রকল্পে কাজ করতে খুব আগ্রহী ছিলাম। ব্র্যাকে এসে সেই সুযোগটাও পেয়েছি। এখানে সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট ক্লাবের সদস্য হয়ে গেছি। পাশাপাশি ব্র্যাক পাবলিক হেলথ কমিউনিটির সঙ্গে কাজ করতেও খুব ভালো লাগে। কারণ, আমাদের আগ্রহের জায়গাটা এক। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সবকিছুই দারুণ উপভোগ করছি। কাছের মানুষেরা যদি পরামর্শ চায়, বাংলাদেশে পড়তে আসবে কি না, আমি ইতিবাচক উত্তরই দেব।
আরও মানসম্পন্ন শিক্ষা আশা করেছিলাম
আমাত সেকা, গাম্বিয়ার নাগরিক, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী
উচ্চশিক্ষার জন্য আমার বাংলাদেশে আসার পেছনে একটা মজার ঘটনা আছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক তাবলিগ জামাতে আমার দেশ গাম্বিয়ায় গিয়েছিলেন। সেখানেই তাঁর সঙ্গে পরিচয়। পরে তিনি আমাকে বলেছিলেন যে তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাষক। তিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানান। বিভিন্ন বিষয় চিন্তা করে অবশেষে বাংলাদেশে আসার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিই।
এখানে আসার পর আমার মিশ্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। এখানকার মানুষ খুব সহযোগিতা করে। কিন্তু আমি আরও মানসম্পন্ন শিক্ষা আশা করেছিলাম, গাম্বিয়া থেকে যেটা অনেক ওপরে হবে। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো পাঠদানের মাধ্যম এখানে বাংলা, একজন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী হিসেবে যেটি আমার জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং। এটা সত্যি, যে চিন্তা করে এখানে এসেছিলাম, তার পুরোটা পাইনি, কিন্তু একটা কথা বলতেই হবে যে স্থানীয় শিক্ষার্থীরা আমাকে অনেক সাহায্য করে। আমার মনে হয়, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভাষা শেখার প্রক্রিয়াটা আরও সহজ হলে ভালো হতো। এই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যদি সহযোগিতা করত, তাহলে খুব ভালো হতো। আমার অনেক পরিচিতকেই বাংলাদেশে আসার কথা বলি। তবে আমার সার্বিক অভিজ্ঞতা শুনে খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করে না। তাই এসব দিকে আরেকটু মনোযোগী হওয়া উচিত।
খণ্ডকালীন কাজের সুযোগ নেই
আবুবকর ওয়ারসামে, সোমালিয়ার নাগরিক, ঢাকার আইইউবিএটির কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র
বাংলাদেশে আসার পেছনে আমার বন্ধুদের ভূমিকা সবচেয়ে বড়। তারা কয়েকজন আগে থেকেই ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজিতে (আইইউইএটি) পড়াশোনা করত। এখানে আসার জন্য তারাই আমাকে উৎসাহিত করে।
যেহেতু বন্ধুরা ছিল, তাই এখানে মানিয়ে নেওয়াটা আমার জন্য খুব একটা সমস্যা হয়নি। এ কথা সত্যি যে শুরুতে আমি যখন আসি, তখন কেনাকাটা করতে গেলে অনেক ঝামেলা পোহাতে হতো। কারণ, এখানকার বেশির ভাগ মানুষই ইংরেজি বোঝে না।
আমার একটা ধারণা ছিল, বাংলাদেশে এসে পড়াশোনা করার পর আমি আমার পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরি করতে পারব। কিন্তু সব মিলিয়ে এখানে এ ধরনের সুযোগ কম। বৃত্তির আওতায় এখানে আমার টিউশন ফি দিতে হয় না। কিন্তু থাকা-খাওয়ার খরচ তো নিজেকেই দিতে হয়। সেসবের ব্যবস্থা করতে গিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছে।
এখানকার পড়াশোনা আমার ভালোই লাগে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অফিসের সহযোগিতার ফলে আমাদের যেকোনো ধরনের সমস্যা সহজেই সমাধান করা যায়। যদিও এখনো হয়তো শতভাগ সন্তুষ্ট বলা যাবে না, কিন্তু আমার পরিচিতজনেরা এখানে আসতে চাইলে সাদর আমন্ত্রণই জানাব।
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার সার্বিক পরিবেশ নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করার ফলে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ হয়। বিশেষ করে স্থানীয় শিক্ষার্থীদের প্রতি আলাদা করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই। তারা সহযোগিতা না করলে মানিয়ে নেওয়াটা খুব কঠিন হতো। বিশ্ববিদ্যালয়, আমার বন্ধুবান্ধব, বাংলাদেশি সহপাঠী, সবার সহযোগিতায় আমার একাডেমিক জীবনটা তুলনামূলক সহজ হয়েছে।