দিনাজপুরের ট্রাক্টরচালক হৃদয়চন্দ্র যেভাবে ‘ইংলিশম্যান’ হয়ে উঠলেন
ট্রাক্টর চালাতে চালাতে অনর্গল ইংরেজি বলছেন এক তরুণ, যা নেটিজেনদের অনেকেরই হয়তো এমন ভিডিও চোখে পড়েছে। এই তরুণের নাম হৃদয়চন্দ্র রায়। দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার সাধুপাড়া গ্রামে তাঁর বাড়ি।
সুধীরচন্দ্র–রাধা রানী দম্পতির দুই ছেলের মধ্যে হৃদয় ছোট। তাঁর বাবাও ছিলেন ট্রাক্টরচালক। বাবার কাছ থেকেই ট্রাক্টর চালনায় তাঁর হাতেখড়ি। বয়সের ভারে বাবা এখন আর কাজ করতে পারেন না। হৃদয় ও তাঁর ভাইয়ের কাঁধেই এখন সংসারের ভার। বছর দু–এক আগে ঋণ করে একটি ট্রাক্টর কিনেছেন। দুই ভাই সেটি চালান। যা আয় হয়, তা দিয়েই চলে সাতজনের সংসার।
ট্রাক্টর চালনা ও কৃষিকাজের পাশাপাশি ঘুরে বেড়ানো, ইংরেজি সিনেমা দেখা ও গান শোনার প্রতি হৃদয়ের ঝোঁক আছে। কিন্তু ইংরেজিতে কথা বলে ভিডিও বানানোর শুরুটা কীভাবে হলো? কীভাবে হৃদয় হয়ে উঠলেন ইংলিশম্যান? বিস্তারিত জানতে হৃদয়দের দোচালা টিনের বাড়িতে গিয়েছিলাম ৯ এপ্রিল।
যেভাবে রপ্ত হলো ইংরেজি
মাধ্যমিকে পড়ার সময়ই তৈরি হয় ইংরেজির প্রতি আগ্রহ। স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে ছোট ছোট বাক্যে ইংরেজি বলার চেষ্টা করতেন হৃদয়চন্দ্র রায়। ২০১৮ সালে সেতাবগঞ্জ মডেল পাইলট স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ ৪.৮৫ পেয়ে পাস করেন। ভর্তি হন সেতাবগঞ্জ সরকারি কলেজে। ২০২০ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৪.৮৩ পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেন। পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকে ভর্তিও হয়েছিলেন। কিন্তু দারিদ্র্য ঘোচাতে শেষ পর্যন্ত তাঁকে আয়রোজগারের পথ খুঁজতে হয়। বন্ধ হয় কলেজে যাওয়া। তবে ইংরেজিটা আরও ভালো করে রপ্ত করার আগ্রহটা কিন্তু ঠিকই বুকপকেটে জমা রেখেছিলেন।
ভালো ইংরেজি জানেন, এমন কারও সন্ধান পেলেই তাঁর কাছে ছুটতেন হৃদয়। রাতে টেলিভিশনে ইংরেজি সংবাদ শুনতেন। সপ্তাহে দুই দিন ইংরেজি পত্রিকা কিনে পড়তেন। হৃদয় বলেন, ‘সংবাদের দিকে যতখানি মনোযোগ থাকত, তার চেয়ে বেশি মনোযোগ থাকত ইংরেজি ভাষা শেখার প্রতি। ভাষাটা টুকটাক আয়ত্তে আসতে লাগল। কিন্তু একা একা এটা হয় না। পার্টনার লাগে। অধিকাংশ সময় বড় ভাই পাশে থাকে। সে–ও উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে আর পড়েনি। ভাইয়ের সঙ্গেই কথা বলার চেষ্টা করতাম। এই কয়েক বছরে ইংরেজিতে ভাইয়েরও উন্নতি হয়েছে। আমার মতো অনর্গল বলতে না পারলেও সবকিছু বোঝে।’
বছরখানেক আগে হৃদয়ের নজরে আসে হিমাদ্রী রানী নামে এক নারীর ফেসবুক প্রোফাইল। তাঁর আপলোড করা কনটেন্টগুলো দেখে উৎসাহ পান। এর পর থেকে ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইংরেজি টক শো ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বক্তব্য শুনতে থাকেন। পাশাপাশি চোখ রাখেন ইংরেজি ব্যাকরণ বইয়ে। তাঁর মতে, বর্তমান সময়ে ইংরেজি ভাষা শেখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে প্রথমে ইংরেজি শোনার দক্ষতা, পড়ার দক্ষতা, বলার দক্ষতা, সব শেষে লেখার দক্ষতা তৈরি করা দরকার। তবে হুটহাট ইংরেজি বললে অনেকে ভালোভাবে নেয় না, মনে করে অহংকারী। হৃদয় ওসব আমলে নেন না।
অনলাইনের বাইরে
২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে বিভিন্ন কনটেন্ট তৈরি করে ফেসবুকে আপলোড করতে থাকেন হৃদয়। ফেসবুক পেজটির নাম দেন ‘ইংলিশম্যান হৃদয় দিনাজপুর’। এলাকায় আগে থেকেই অনেকে তাঁর ব্যাপারে জানতেন। ফেসবুকের কল্যাণে আরও বেশি মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর গল্প। অবশ্য শুধু ফেসবুকেই আটকে নেই ‘ইংলিশম্যান’ হৃদয়। পাড়ার সাত ছেলেমেয়েকে সরাসরি ইংরেজি শেখান তিনি। অনলাইনেও কয়েকজনকে ইংরেজি শেখাচ্ছেন।
সাধুপাড়ার মেয়ে তাপসী রায় দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তাপসী বলে, ‘হৃদয় কাকুর কাছে ইংরেজি শিখছি। ক্লাসে ইংরেজিতে ভালো করেছি। রিডিং পড়তে সমস্যা হয় না। উচ্চারণ শিখছি। পাঠ্যবইয়ের পড়াগুলোর কম–বেশি বাংলাও করতে পারি। আমাদের পাড়ার আরও কয়েকজন হৃদয় কাকুর কাছে ইংরেজি শিখছে।’
ইংরেজিতে হৃদয়ের এমন উন্নতি দেখে অনেকেই বাড়িতে তাঁকে খোঁজ করতে আসেন। হৃদয়ের বাবা সুধীরচন্দ্রকেও অনেকে এখন ইংলিশম্যানের বাবা হিসেবে চেনেন। সুধীরচন্দ্র (৬৫) বলেন, ‘বয়স হয়েছে। সংসার চালানোর সামর্থ্য নেই। ছেলে দুইটার মাথা ভালো ছিল। কিন্তু পড়ালেখা করাতে পারলাম না। ছোট ছেলেটা এখনো রাত জেগে বই পড়ে। তখন আফসোস হয়, ছেলেটাকে যদি পড়ালেখা করাতে পারতাম।’
হৃদয় বলেন, ‘বেশি দূর পড়ালেখা করা হয়নি, তাতে আক্ষেপ নেই। পরিবারের পাশে তো দাঁড়িয়েছি। তবে এখন মনে হয়, পড়ালেখাটা চালিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। ইংরেজিতে আরও ভালো করার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি এলাকার ছেলেমেয়েগুলোর ইংরেজিভীতি দূর করতে কাজ করছি। কারণ, আমি মনে করি বর্তমান সময়ে অন্তত ইংরেজি ভাষাটা যদি কেউ ভালো করে শেখে, চাকরির ক্ষেত্রে অনেক সহায়ক হবে।’ আর্থিক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলে অন্তত স্নাতকটা শেষ করার ইচ্ছা এই তরুণের আছে।
হৃদয় প্রসঙ্গে সেতাবগঞ্জ সরকারি কলেজের ইংরেজির শিক্ষক নিজামুল হক বলেন, ‘ইংরেজির প্রতি হৃদয়ের আগ্রহ আছে। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে আগ্রহটা কয়েক গুণ বেড়েছে। যেহেতু পড়ালেখাটা বন্ধ, তাই সোশ্যাল মিডিয়াটাকে শেখার একটা প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বেছে নিয়েছে। এখনো কিছু ঘাটতি আছে। তবে জড়তা কাটিয়ে উঠেছে অনেকটা। শেখার এই আগ্রহই হয়তো তাকে ইংরেজিতে আরও ভালো হতে সহায়তা করবে।’