ক্যাম্পাসের কুকুরগুলো কি জনিকে মিস করবে
বছরের শেষ দিনে অনেকে যখন ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ উদ্যাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে দেখা গেল কুকুরের জন্য তহবিল (ফান্ড) সংগ্রহ করতে। জানা গেল, বছরের শেষ দিনে ক্যাম্পাসের কুকুরগুলোকে ভালোমন্দ খাওয়াতে চান তিনি। একটা দিন ওদের সঙ্গে কাটাতে চান। এই উদ্যোগে শামিল হয়ে গেলেন অনেকে। টাকাপয়সা যা উঠল, তা দিয়ে ছয় কেজি মুরগি ও আট কেজি চালের খিচুড়ি রান্না হলো। কুকুরগুলো যে আনন্দ পেল, আয়োজকদের আনন্দও কি তার চেয়ে কম?
এ রকম অসংখ্য উদ্যোগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী জনি রায়ের নাম। কীভাবে তিনি প্রাণী প্রেমে উদ্বুদ্ধ হলেন? জানতে ফিরে যেতে হবে জনির শৈশবে। ‘যখন ছোট ছিলাম, বাসায় একটা কুকুর পুষতাম। একদিন এক দুর্ঘটনায় হাসপাতালে ভর্তি হই। সে সময় এক লোক কুকুরটিকে পিটিয়ে কোমর ভেঙে ফেলে। এসবের কিছুই জানতাম না আমি। বাসায় এসে দেখি, এই অবস্থায়ও ও আমার কাছে এসে বসে আছে। এর কিছুদিন পর কুকুরটি মারা যায়। এই ঘটনা আমার মনে দাগ কেটে যায়। কুকুর বা প্রাণী নিয়ে কাজ করার আগ্রহ তখন থেকে তৈরি হয়’, বলছিলেন জনি।
ক্যাম্পাসে যেভাবে শুরু
তখন কোভিডকাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, ক্যাফেটেরিয়া ও বেশির ভাগ খাবারের দোকান বন্ধ থাকায় কুকুরগুলোর বেহাল দশা। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে একত্র হন। গড়ে তোলেন প্রাণী কল্যাণভিত্তিক সংগঠন চিটাগং ইউনিভার্সিটি অ্যানিমেল লাভারস সোসাইটি। জনি এই সংগঠনে যুক্ত হন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, আশপাশের হোটেল থেকে উচ্ছিষ্ট এনে খাওয়াবেন তাঁরা। কিছুদিন চলল এভাবে। পরবর্তী সময়ে জোগানের স্বল্পতা দেখা দিলে শিক্ষার্থীরা খাবার রান্না করে, দোকান থেকে রুটি কিনে, মুরগির উচ্ছিষ্ট অংশ সংগ্রহ করে কুকুরকে দেন। সে যাত্রায় প্রায় দেড় শ কুকুরের প্রাণ রক্ষা হয়।
খাবারের বন্দোবস্ত করা জনির একমাত্র কাজ নয়। সঙ্গে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, প্রতিষেধক (র্যাবিশ ভ্যাকসিন) দেওয়া, উদ্ধার অভিযান পরিচালনাও করেন তিনি। জনি রায় জানালেন, এখন পর্যন্ত ২৭টির বেশি কুকুরকে উদ্ধার, ৬০টির বেশি কুকুরকে প্রতিষেধক প্রদান ও ৮০টির বেশি কুকুরকে চিকিৎসা দিয়েছেন তিনি। আছে বিড়াল, শূকর ও শজারু নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতাও। এসব কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের লাসানি আরফিন, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের রেহেনুমা হক, পালি বিভাগের পিয়া মনি চাকমা, ইতিহাস বিভাগের কবির হাসান, উৎস মাহমুদ ও সাকিবুর রহমানও যুক্ত ছিলেন।
প্রাপ্তি কী
মূলত চার ধরনের চ্যালেঞ্জ তাঁদের মোকাবিলা করতে হয়। মানুষের নেতিবাচক মন্তব্য, আর্থিক সমস্যা, লোকবল সংকট ও নিজেদের ব্যস্ততা। জনি রায় এই বিষয়গুলোকে ব্যাখ্যা করলেন এভাবে, ‘কোনো কুকুরের গায়ে ঘা হলে, আমরা যখন তার চিকিৎসা করি। তখন অনেক মানুষ বলে, এগুলোর দরকার কী! অজনপ্রিয় ও স্বেচ্ছাসেবী কাজ হওয়ায় বেশির ভাগ লোক এতে আগ্রহ দেখান না। আবার, নিজেদেরও ব্যস্ততা থাকে।’
স্নাতকোত্তর পরীক্ষা শেষ হয়েছে, শিগগিরই হয়তো ক্যাম্পাস ছেড়ে যাবেন। কুকুরগুলো নিশ্চয়ই জনিকে খুঁজবে! কিন্তু এসব কাজ কি থেমে যাবে তখন? জনি তেমনটা মনে করেন না। বললেন, ‘আমি আশা করি থামবে না। আমার কোন অনুজ, ভাই-ব্রাদার কাজটা চালিয়ে নেবে। আর তাদের সাহায্য, দিকনির্দেশনার দরকার পড়লে আমি তো আছিই।’
প্রাপ্তির খাতায় বোবা প্রাণীগুলোর ভালোবাসা তো আছেই। ভালো লাগা আছে আরও। জনি বলেন, ‘বন্ধুরা যখন বলে, এই কাজগুলোর জন্য তোকে সম্মান করতে ইচ্ছা করে, তখন আমার ভালো লাগে। আমার ভালো লাগে এটা ভেবে যে, আমার অনেক কিছু নিয়ে ওদের হয়তো আপত্তি আছে। তারপরও একটা জায়গায় এসে ওরা আমাকে সম্মান করছে। আমি সম্মান না চাইলেও করছে।’