নানা রকম শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যান একজন হবু মা। শারীরবৃত্তীয় নানা পরিবর্তন এ সময় ঘটে, যার মধ্যে রক্তচাপও আছে। আগে থেকেই যাঁদের উচ্চ রক্তচাপ আছে এবং ওষুধ খান, সন্তান ধারণের আগে অবশ্যই তাঁদের চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ, উচ্চ রক্তচাপের কিছু কিছু ওষুধ গর্ভাবস্থায় ব্যবহার করা যায় না। গর্ভধারণের পরিকল্পনা করলে চিকিৎসক আগে থেকেই সেসব পরিবর্তন করে নিরাপদ ওষুধে চলে যাবেন। আর যাঁদের আগে থেকে উচ্চ রক্তচাপ নেই, তাঁরা প্রতি অ্যান্টিন্যাটাল ভিজিটে (প্রসবপূর্ব চিকিৎসাসেবা) অবশ্যই রক্তচাপ মাপাবেন।
গর্ভকালীন প্রথম তিন মাস রক্তচাপ স্বাভাবিকভাবে কিছুটা কমের দিকে থাকে। পাঁচ মাসের পর থেকে কারও কারও উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা দেখা যায়। গর্ভকালীন রক্তচাপ বেড়ে গেলে নানা জটিলতার আশঙ্কা থাকে। প্রি-একলাম্পসিয়া এদের মধ্যে অন্যতম।
গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ
গর্ভধারণের প্রথম পাঁচ মাসের মধ্যেই যদি উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে, তবে তাকে গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ না বলে ক্রনিক উচ্চ রক্তচাপের রোগী বলা হয়। অর্থাৎ আগে থেকেই তাঁর উচ্চ রক্তচাপ আছে বলে ধরতে হবে। আর গর্ভধারণের পাঁচ মাস অতিক্রম করার পর যদি প্রথম কারও উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে, তবেই তাকে গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ বা প্রেগনেন্সি ইনডিউসড হাইপারটেনশন বলা হয়।
গর্ভকালীন সিস্টোলিক রক্তচাপ ১৪০ মিলিমিটার পারদের সমান বা তার বেশি অথবা ডায়াস্টলিক রক্তচাপ ৯০ মিলিমিটার পারদের সমান বা তার বেশি অথবা যদি দুটোই এই মাত্রার সমান বা তার বেশি হয়, তখন তাকে গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কারণ
গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ বিভিন্ন কারণে হতে পারে। যেমন অতিরিক্ত ওজন, খাবারে মাত্রাতিরিক্ত লবণ, স্বাভাবিক কায়িক শ্রমের অভাব, ধূমপান, মদ্যপান বা অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপনের বদভ্যাস। এ ছাড়া প্রথমবার গর্ভধারণ, যমজ গর্ভধারণ, কৃত্রিম উপায়ে গর্ভধারণ (টেস্টটিউব বেবি), পারিবারিক উচ্চ রক্তচাপের ইতিহাস এবং ২০ বছরের কম বা ৪০ বছরের বেশি বয়সে মা হলে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বেশি।
কীভাবে বুঝবেন
গর্ভবতী মায়ের উচ্চ রক্তচাপের প্রথম দিকে উল্লেখযোগ্য কোনো লক্ষণ না–ও থাকতে পারে। কারণ, বেশির ভাগ উচ্চ রক্তচাপেরই দীর্ঘদিন কোনো লক্ষণ থাকে না। নিয়মিত রক্তচাপ মাপাই হলো উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত করার একমাত্র উপায়। গর্ভধারণের পর থেকে নিয়মিত রক্তচাপ মাপতে হবে। এ সময় মায়ের প্রস্রাবের অ্যালবুমিন, রক্তের হিমোগ্লোবিন, রক্তের গ্রুপসহ কিছু ল্যাবরেটরি পরীক্ষা অবশ্যই করতে হবে। একে বলে অ্যান্টিন্যাটাল চেকআপ। নিয়মিত অ্যান্টিন্যাটাল চেকআপে থাকলে গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে।
প্রি-একলাম্পসিয়া
গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপের জন্য মায়ের শরীর থেকে প্রস্রাবের সঙ্গে আমিষ বা প্রোটিন বের হয়ে যেতে পারে। তখন পানি জমে পা ফুলতে পারে। এমনকি পুরো শরীর ফুলে যেতে পারে। এ অবস্থাকে বলে প্রি-একলাম্পসিয়া। এটা থেকে গর্ভকালীন খিঁচুনি হতে পারে। গর্ভকালীন খিঁচুনি মা ও গর্ভস্থ শিশুর জন্য খুবই বিপজ্জনক। প্রি-একলাম্পসিয়ায় মায়ের যকৃৎ ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কমতে পারে রক্তের প্লাটিলেট। জন্ডিস এবং শরীর থেকে রক্তক্ষরণের মতো মারাত্মক জটিলতাও তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ যখন বিপজ্জনক
রক্তচাপ খুব বেড়ে গেলে মায়ের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসমূহ বিশেষ করে হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক, কিডনি, যকৃৎ, রক্তনালি ও চোখ আক্রান্ত হতে পারে। হার্ট বড় হয়ে যাওয়া, হার্ট ফেইলিউর, স্ট্রোক, কিডনির কার্যকারিতা হ্রাসসহ গর্ভবতী মা বড় রকমের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে পারেন। এ সময় শ্বাসকষ্ট, বুকব্যথা, ঝাপসা দৃষ্টি, লালচে প্রস্রাব, নাক দিয়ে রক্ত পড়া, মাথাব্যথা, শরীরের অংশবিশেষের দুর্বলতা কিংবা অবশ হওয়া এবং খিঁচুনি হতে পারে। এসব লক্ষণ গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপের জটিলতা নির্দেশ করে। গর্ভস্থ শিশু অক্সিজেন স্বল্পতায় ভুগতে পারে। ব্যাহত হতে পারে তার বৃদ্ধি। জন্ম নিতে পারে কম ওজনের শিশু বা অপরিণত শিশু। গর্ভস্থ শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
করণীয়
যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ বা এর থেকে সৃষ্ট প্রি-একলাম্পসিয়া নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ যাতে না হয়, তার জন্য আগে থেকেই সচেতন হতে হবে। উচ্চ রক্তচাপের প্রতিরোধব্যবস্থা সবাইকে জানতে হবে।
১. যাঁরা আগে থেকেই উচ্চ রক্তচাপের রোগী, গর্ভধারণের আগেই তাঁদের সতর্ক হতে হবে। চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। গর্ভধারণের আগে তাঁদের ওষুধ পরিবর্তনের দরকার হতে পারে।
২. যে নারীদের ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, থাইরয়েডের সমস্যা আছে, তাঁদের ঝুঁকি অনেক বেশি। এর যথাযথ চিকিৎসা করতে হবে।
৩. গর্ভাবস্থায় নিয়মিত রক্তচাপ মাপতে হবে। রক্তচাপ বেশি থাকলে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ওষুধ সেবন করতে হবে।
৪. চিকিৎসকের পরামর্শে নিয়মিত প্রস্রাবের অ্যালবুমিন ও অন্যান্য কিছু রক্তের ল্যাবরেটরি পরীক্ষা করতে হবে।
৫. আলাদা লবণ খাওয়া যাবে না। অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবারও নয়। সালাদ বা ফলের সঙ্গে বাড়তি লবণ, আচার, চানাচুর, সয়াসস ও টেস্টিং সল্টযুক্ত খাবার, প্রক্রিয়াজাত খাবারে অতিরিক্ত লবণ ব্যবহৃত হয়।
৬. অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার, গরু-খাসির মাংস, ভাজা-পোড়া এড়িয়ে চলতে হবে।
৭. প্রচুর তাজা শাকসবজি ফলমূল খেতে হবে। ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। দুধ, দই, পনির, কাঁটাযুক্ত ছোট মাছ, সামুদ্রিক মাছ, শিম, গাজর ইত্যাদিতে ক্যালসিয়াম আছে।
৮. চিকিৎসকের পরামর্শমতো নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হবে। রক্তচাপ ১৫০/১০০–এর বেশি হলেই ওষুধ লাগবে।
৯. ধূমপান, জর্দা, তামাক, অ্যালকোহল একেবারেই নিষিদ্ধ।
১০. উচ্চ রক্তচাপের জটিলতা দেখা দিলে বা রক্তচাপ ১৭০/১১০ মিলিমিটার পারদ বা তার বেশি উঠে গেলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
অনুলিখন: ডা. শরদিন্দু শেখর রায়