সম্পর্ক বিষিয়ে গেছে? কী করবেন?
বন্ধুদের সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন রিফাত। এমন সময় হঠাৎ-ই তাঁর প্রেমিকার ফোন। ফোন কানে তুলতে না তুলতেই মাহির প্রশ্ন, ‘তুমি নাদিয়ার ছবিতে লাইক দিয়েছ কেন?’ রিফাত বুঝে গেলেন, আজ কপালে খারাবি আছে! গত কয়েক দিনে তেমন কিছু হয়েছে কি না, মনে করার চেষ্টা করলেন রিফাত। ওহ, হ্যাঁ। গত পরশু মাহি ও তাঁর বন্ধুরা মিলে গিয়েছিলেন আরেক বিয়েতে। সেখান থেকেই গতকাল রাতে নাদিয়ার একটা ছবি ফেসবুক ফিডের সামনে চলে এসেছিল। ভুলে হয়তো লাইক পড়ে গেছে, খেয়াল নেই। এই সামান্য বিষয়টাকে তিল থেকে তাল বানিয়েছেন মাহি। বন্ধুদের থেকে একটু দূরে সরে বিষয়টা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেন। বহু বুঝিয়ে সেখানেই নাদিয়াকে ব্লক করার পর সামান্য শান্ত হলেন মাহি।
বন্ধুদের কাছে ফিরতে না ফিরতেই প্রথম প্রশ্ন, ‘কেন আছিস এই রিলেশনশিপে?’ রিফাতও যথেষ্ট বিব্রত। এক বছরের সম্পর্ক, প্রথম দিকে ভালোই চলছিল। কিন্তু গত কয়েক মাসে মাহির সন্দেহপ্রবণতা বেড়ে গেছে বহুগুণ। গত ২ মাসে এই নিয়ে ১২ বার ঝগড়া হলো, প্রতিবারই শুরুটা হয়েছে ওপাশ থেকে।
গল্পটা অনেকের কাছেই পরিচিত ঠেকতে পারে। এমন দৃশ্য এখনকার সময়ে নতুন কিছু নয়। আশপাশে অনেক সম্পর্কেই দেখা যায় এমনটা। বাইরে থেকে দেখে দুজনকে ভালোই লাগছে, দুজনের মধ্যে সম্পর্কটাও অটুট। কিন্তু একটু কঠিন সময় এলেই দুজনের স্বরূপটা বেরিয়ে আসে। একজনের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম ভুল অন্যজন সহ্য করতে পারছেন না। ঈর্ষা, মানসিক সমর্থনের অভাব, পরিপক্বতার অভাব, বোঝাপড়ায় সমন্বয়হীনতা—এমন বহুভাবে একটা ভালো সম্পর্ক মোড় নিতে পারে টক্সিক রিলেশনশিপ।
একটা সম্পর্কে চিড় ধরলে সবার আগে প্রয়োজন যত্নের। সম্পর্ক একটা গাছের মতো, যত দিন যাবে, তত বড় হবে। এর মধ্যে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, বসন্ত সবই আসবে। শীতের পাতাঝরা মৌসুম দেখে হাল ছেড়ে দিলে বসন্তের দেখা পাওয়া যাবে না কোনো কালেই। কারণ, শীতের পরেই আগমন ঘটে বসন্তের। কিন্তু তাই বলে একটি মরা গাছে ক্রমাগত পানি ঢালার অর্থ হয় না। টক্সিক সম্পর্কে ধরে রাখা যতটা কষ্টের, তার থেকে বেশি কষ্ট সেই সম্পর্ক থেকে সরে আসা। টক্সিক সম্পর্কে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এক পক্ষের ভালোবাসা সর্বদাই বজায় থাকে। সম্পর্ক নামের গাছে সর্বদাই পানি দেওয়ায় মত্ত থাকে সে। এর মধ্যে তার নজর এড়িয়ে যায় যে গাছটা আসলে অনেক আগেই মরে গেছে।
ভালোবাসুন, তবে নিজের স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে নয়
টক্সিক রিলেশনশিপে থাকার অন্যতম বড় কারণ হচ্ছে সম্পর্কে নিজের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা না থাকা। একটা সম্পর্কে উত্থান-পতন থাকবেই। কিন্তু যখন খেয়াল করবেন, বেশির ভাগ সময় আপনাকেই পতনের অংশীদার হতে হচ্ছে, প্রেমের সম্পর্ক চালাতে গিয়ে আপনার অন্যান্য পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক জলাঞ্জলি দিতে হচ্ছে, সবচেয়ে বড় কথা, নিজের ব্যক্তিগত জীবন আর স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়ছে। আরেকজনকে ভালোবাসার আগে নিজেকে ভালোবাসুন। আরেকজনকে ভালোবাসতে গিয়ে যদি নিজের স্বাভাবিকতাই বদলে ফেলতে হয়, তাহলে সেটা সুস্থ সম্পর্ক নয়! তখনই বুঝবেন সম্পর্কটা আর সুস্থ নেই। বিষাক্ত সম্পর্ক থেকে বের হওয়ার প্রথম পদক্ষেপ হলো উপলব্ধি করা যে এই সম্পর্ক আপনার জন্য হেলদি নয়। অপর পক্ষের প্রতিটি কাজের পেছনে নিজের মনকে অজুহাত না দিয়ে বরং সম্পর্কের লালবাতিগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নিন।
নিজের সিদ্ধান্তের ওপর ভরসা রাখুন
মনে রাখবেন, দুজনের একটা সম্পর্কে জড়ানোটা যত কঠিন, বের হওয়া তার চেয়ে ঢের বেশি কঠিন। আজ হয়তো দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা বিষিয়ে গেছে, কিন্তু একদিন ঠিকই দুজনের দুজনের প্রতি টান ছিল, মায়া ছিল, মমতা ছিল। চাইলেও সেটাকে ধুয়ে-মুছে ফেলা সম্ভব না। তাই সম্পর্কের ইতিটাও যেন সে রকম হয়, সেটাও মাথায় রাখা জরুরি। কারণ, আপনি বের হতে চাইলেও অপর পক্ষ চাইবে সম্পর্ক ধরে রাখার। সে ক্ষেত্রে আপনার নিজের সিদ্ধান্তের ওপর ভরসা রাখাটা জরুরি।
মন শক্ত করে ইতি টানুন
এবার আসে কঠিন সিদ্ধান্তকে বাস্তবে রূপান্তর করার বিষয়। মুখে বলা যতটা সহজ, করা ততটা সহজ নয়। ব্রেকআপ করাটা সব সময়ই কঠিন, বিশেষ করে টক্সিক রিলেশনশিপে। সে জন্য কী বলবেন, সেটা আগেই ভেবে নিন। মেজাজের খেই হারাবেন না। পুরোনো স্মৃতি, ঝগড়া যত তুলে আনবেন, বিষয়টি তত খারাপের দিকে যাবে। তাতে সম্পর্ক চুকানো তো হবেই না, উল্টো দেখা যেতে পারে দিনটা নিত্যদিনের আরেকটি ঝগড়ায় পরিণত হয়েছে। পা ফসকে আবেগের গর্তে পড়ে খেই হারাবেন না। সম্পর্কটা যে আর কাজ করছে না, সে ব্যাপারে আগে থেকেই স্পষ্ট হন। শুধু অপর পক্ষের নয়, নিজের ভুলগুলোও তুলে ধরে সম্পর্কে যে আর থাকতে চান না, সেটাও বুঝিয়ে বলুন। দুজনের বোঝাবুঝিই পারে সম্পর্ক সমাপ্তির তিক্ত অভিজ্ঞতা কিছুটা হলেও লাঘব করতে।
শক্ত থাকুন ও নিজেকে ভালোবাসুন
টক্সিক রিলেশনশিপে থাকাটা শুধু নিজের মন নয়, শরীরের ওপরও অনেক বড় প্রভাব ফেলে। একটা সম্পর্ক ছেড়ে আসা সহজ বিষয় নয়। ছেড়ে আসার কিছুক্ষণ পরেই মনে হবে, সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল না তো? যেমনই হোক ছিল তো...ফিরে যাওয়ার তাড়না মনে মনে পোড়াবে। এমন সময় নিজেকে শক্ত রাখাটা জরুরি। জীবন থেকে ভালোর জন্য যাকে দূর করে দিয়েছেন, তাকে আবার ডেকে আনার প্রয়োজন নেই। বরং নিজেকে যে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাচ্ছিলেন, তাতে মনোযোগ দিন। টক্সিক রিলেশনশিপ আপনার উন্নতিতে যে বাধাটা দিচ্ছিল, সেটাকে উতরে নতুন মানুষ হিসেবে নিজেকে তৈরি করুন। সমস্ত ইতিবাচকতা আর শুভবোধকে নিজের দিকে টেনে নিন। সৃজনশীল কাজে মনোযোগ দিন। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান। কাছের মানুষ, যেমন মা, বাবা, ভাই, বোন বা বন্ধুকে মনের কথা খুলে বলুন।
মনে রাখবেন, আপনার অতীত আপনার শত্রু নয়, বন্ধু। অতীত থেকে যাঁরা শিক্ষা নেন না, তাঁরাই নিজের অতীতকে শত্রু হিসেবে গণ্য করেন। প্রতিটি দিন, প্রতিটি অভিজ্ঞতা আপনাকে এক নতুন মানুষ হিসেবে তৈরি করবে। আপনার বিষিয়ে যাওয়া সম্পর্কের সমাপ্তি হোক জীবনের নতুন শুভসূচনা।
সূত্র: সাইকোলজি টুডে ও ইন্ডিয়া টুডে