পারমাণবিক বিদ্যুতের সহজ সমাধান

সৈয়দ বাহাউদ্দিন আলম। ছবি: সংগৃহীত
সৈয়দ বাহাউদ্দিন আলম। ছবি: সংগৃহীত
>

আমি অার্গন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির যে ল্যাবে কাজ করছি, তার নাম অ্যাডভান্সড ফোটন সোর্স ল্যাব। ওই ল্যাবে গত ১০ বছর আমার পাঁচজন কলিগ নোবেল পুরস্কার পান। আমি পুরো ল্যাবরেটরির কথা বলছি না, শুধু একটা বিভাগের কথা বলছি। মজার ব্যাপার হলো কফি ব্রেকে তাঁদের প্রায়ই এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করতে দেখি। তাঁদের চোখের সামনে ঘোরাফেরা করতে দেখাও সৌভাগ্যের ব্যাপার। 

ফেসবুকে ‘নিউক্লিয়ার স্কুল’ নামে একটি পেজে সম্প্রতি এ রকম একটা পোস্ট দিয়েছেন সৈয়দ বাহাউদ্দিন আলম। এই পেজটা আসলে বাংলায় পরমাণুবিজ্ঞান শেখানোর একটা প্রচেষ্টা। বাহাউদ্দিন নিজেই চালান এই পেজ। কোন মানের গবেষণাকেন্দ্রে বাংলাদেশি এই বিজ্ঞানী কাজ করেন, তার আভাস ওপরের কথাগুলো থেকেই পাওয়া যায়।

‘পরমাণুবিজ্ঞানী’ শুনলে পাকা কিংবা কাঁচা-পাকা চুলের গম্ভীর, ভাবুক যে অবয়ব ভেসে ওঠে, বাহাউদ্দিন তা নন। তাঁর বয়স ৩১ বছর। পরমাণু প্রকৌশলে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কাজ করেন ফ্রান্সের পারমাণবিক শক্তি কমিশনে নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানী হিসেবে। একাডেমিক কোলাবরেটর হিসেবে যুক্ত আছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে ফোনে একদিন যোগাযোগ হলো, তখন তিনি লন্ডনে। পরদিন যখন কথা হলো, তখন বাহাউদ্দিন ফ্রান্সে।

এসব তো হতেই পারে। তবে সৈয়দ বাহাউদ্দিন আলমের আসল কাজ, সত্যিকারের অনন্য জায়গায়। পিএইচডির গবেষণায় তিনি আবিষ্কার করেছেন ছোট আকারের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (পরমাণুবিজ্ঞানের ভাষায় স্মল মডিউলার িরঅ্যাক্টর কোর)। পাবনার রূপপুরে নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশপাশে যাঁরা গিয়েছেন, তাঁরা দেখেছেন কী বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে সেখানে। পারমাণবিক চুল্লি বা নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর মানেই বিশাল কাঠামো। বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই পারমাণবিক চুল্লির আকারটাকে একেবারে ছোট করে এনেছেন বাহাউদ্দিন। যা চাইলে বহনও করা যাবে। পারমাণবিক চুল্লির আকার ছোট রাখতে গিয়ে তাঁকে নতুন পারমাণবিক জ্বালানিও আবিষ্কার করতে হয়েছে। বাহাউদ্দিনের গবেষণার বাস্তবায়ন চলছে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনে। সেখানে বড় জাহাজের জন্য পারমাণবিক ব্যাটারি তৈরি হচ্ছে।

গবেষণাগারে সৈয়দ বাহাউদ্দিন আলম
গবেষণাগারে সৈয়দ বাহাউদ্দিন আলম

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস কৌশলে পড়তেন বাহাউদ্দিন। শেষ বর্ষে বেছে নিলেন ‘পাওয়ার’। মূলত প্রয়াত অধ্যাপক আবদুল মতিনের উৎসাহে পরমাণু শক্তি নিয়ে পড়াশোনা শুরু হয় সৈয়দ বাহাউদ্দিন আলমের। ‘মতিন স্যার আমাকে বলেছিলেন, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সমস্যা প্রকট। এ সমস্যা দূর করতে পারমাণবিক শক্তির বিকল্প নেই। পরমাণুবিজ্ঞান পড়তে হলে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান খুব ভালোভাবে লাগবে।’ বললেন বাহাউদ্দিন। প্রথমদিকে খুবই কঠিন লাগত। কিন্তু লেগে রইলেন। একটা ওয়েবসাইটও বানালেন। অনেকে আবার তা নিয়ে হাসাহাসিও করলেন। কিন্তু সৈয়দ বাহাউদ্দিন আলমের লক্ষ্য ছিল অটুট। পরমাণুবিজ্ঞানী হতেই হবে।

২০১১ সালে বুয়েট থেকে স্নাতক হয়ে কেমব্রিজে ভর্তির জন্য আবেদন করলেন। স্নাতকোত্তর পর্যায়ের জন্য নয়, পিএইচডি করার জন্য। কেমব্রিজ থেকে জবাব এল, ‘তোমার তো নিউক্লিয়ারের কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। তার ওপর সবে স্নাতক করেছ।’ বাহাউদ্দিন নাছোড়বান্দা। পদার্থবিজ্ঞানের ওপর ১৫–২০টা গবেষণাপত্রই তাঁর ভরসা। কেমব্রিজে বিশেষ সভায় বাহাউদ্দিনকে সুযোগ দেওয়া হলো। এক বছরে একটা প্রকল্প ও কোর্স করতে হবে। এটাই হবে তাঁর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। তবে নম্বর পেতে হবে ন্যূনতম ৭৫ শতাংশ। ‘টায় টায় ৭৫ শতাংশ নম্বরই পেলাম। ২০১৩ সালে এই কোর্স শেষ করার পর পেলাম পিএইচডি করার সুযোগ।’ বললেন সৈয়দ বাহাউদ্দিন আলম।

পরিবারের সঙ্গে
পরিবারের সঙ্গে

পিএইচডি কোর্সেও শর্ত কম ছিল না। গবেষণার বিষয় এসএমআর (স্মল মডিউলার রিঅ্যাক্টর), মানে ছোট আকারের পারমাণবিক চুল্লি। বলা হলো এসএমআরের এমন মডেল বানাতে হবে, যা পৃথিবীতে নেই। বাহাউদ্দিন বললেন, প্রচলিত রিঅ্যাক্টর নিয়ন্ত্রণ করা হয় বোরন দিয়ে। আমাকে বলা হলো বোরন ব্যবহার করা যাবে না। বোরন নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেক নল লাগে। এতে চুল্লির আকার বেড়ে যায়। এদিকে পারমাণবিক চুল্লির প্রচলিত জ্বালানি ইউরেনিয়াম ডাই-অক্সাইডের সঙ্গে বোরন না মেশালে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেশি। ‘তাই আমাকে নতুন জ্বালানি খুঁজে বের করতে হলো। নতুন ফুয়েল না বানালে পিএইচডি হবে না। আমি দেখলাম ইউরেনিয়াম ডাই-অক্সাইডের চারপাশে ১০০ শতাংশ থোরিয়াম যোগ করে এটা করা যাচ্ছে। বিশুদ্ধ থোরিয়াম ডাই-অক্সাইড নিউট্রন খেয়ে ফেলে শুধু িরঅ্যাক্টর নিয়ন্ত্রণে সাহায্যই করে না, পাশাপাশি ইউরেনিয়াম ২৩৩ উৎপাদন করে। ফিশন বিক্রিয়ার জন্য এটা প্রচলিত ইউরেয়াম ডাই–অক্সাইডের মূল উপাদান ইউরেনিয়াম ২৩৩–এর বেশি কার্যকর।’ এভাবেই বাহাউদ্দিন তৈরি করলেন মাইক্রো হেটারোজিনিয়াস থোরিয়াম ডাই-অক্সাইড জ্বালানি। নতুন করে নকশা করতে হলো এসএমআরের।

এই গবেষণার জন্য সৈয়দ বাহাউদ্দিন আলম ২০১৫ ও ২০১৬ সালে আমেরিকান নিউক্লিয়ার সোসাইটির এবং ২০১৭ সালে জাপান অ্যাটমিক সোসাইটির সেরা গবেষণাপত্রের পুরস্কার পেলেন। ২০১৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় সেরা পোস্টারের পুরস্কারও পেয়েছেন। ২০১৭ সালে জাপান পারমাণবিক শক্তি কমিশন বাহাউদ্দিনের গবেষণাকে ‘দারুণ উদ্ভাবন’ বলেছে। এ ছাড়াও গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন কেমব্রিজ ট্রাস্ট ও পোস্ট গ্রাজুয়েট পুরস্কার। চলতি বছর বাহাউদ্দিন ফ্রেঞ্চ অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনে পরমাণু গবেষণাবিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দিলেন। তিনি বললেন, ‘এই প্রতিষ্ঠান ২০২৫ সালে নতুন পারমাণবিক চুল্লি আনবে।’

ওয়েবসাইটে পুরস্কার গ্রহণের ছবি
ওয়েবসাইটে পুরস্কার গ্রহণের ছবি

বাহাউদ্দিনের গবেষণার বাস্তবায়ন চলছে যুক্তরাষ্ট্রের রডআইল্যান্ড অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনে। ৩৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে পারমাণবিক ব্যাটারি তৈরি হচ্ছে তার আকার ১.৭ x ১.২ মিটার।

১৯৮৭ সালের ৫ আগস্ট চট্টগ্রামের চান্দগাঁওয়ে জন্ম বাহাউদ্দিনের। বাবা সৈয়দ মইনউদ্দিন আলম ব্যবসায়ী, মা রিনা জাহান গৃহিণী। ছোট বোন সৈয়দা মাফতুহা আলম সফটওয়্যার প্রকৌশলী। ‘ছোটবেলায় গ্রামের স্কুলে পড়তাম। এ নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগতাম। কারণ, কাজিনরা চট্টগ্রাম শহরে পড়ত। মা ও বাবা এ সময় আমার পড়াশোনায় খুব সহযোগিতা করতেন। যখন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হলাম, তখন সব হীনম্মন্যতা কেটে গেল।’ বললেন বাহাউদ্দিন। বাহাউদ্দিনের স্ত্রী তোহফাতুর রিদওয়ান সফটওয়্যার প্রকৌশলী।

ফ্রান্সের মতো দেশে পরমাণুবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করছে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম এ বিষয়টিকে বাংলাদেশের জন্য খুব সম্ভাবনাময় মনে করছেন বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আলী জুলকারনাইন। তিনি বললেন, এই বাহাউদ্দিনেরা একদিন দেশে ফিরে আসবে, দেশের কাজে তাদের অভিজ্ঞতা, প্রযুক্তি ব্যবহার করবে, এটাই আমার আশা। ছোট আকারের রিঅ্যাক্টর এখনো পরীক্ষিত, প্রমাণিত, নিরাপদ প্রযুক্তি নয়। তবে গবেষণার মাধ্যমে যখন এই প্রযুক্তির উন্নতি ঘটবে, এসব চালানোর দক্ষতা তৈরি হবে, তখন ছোট ছোট এই রিঅ্যাক্টরগুলো বাংলাদেশের কাজে আসবে। বাহাউদ্দিনের গবেষণার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখেন মো. আলী জুলকারনাইন।

অ্যাগ্রন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে সহকর্মীদের সঙ্গে
অ্যাগ্রন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে সহকর্মীদের সঙ্গে

বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন ও ব্যবহার শুরু না হওয়া পর্যন্ত এসব ছোট পারমাণবিক চুল্লির সফলতা নিয়ে কিছু বলা যাবে না বলে মন্তব্য করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি বললেন, এ ধরনের উদ্ভাবনী প্রকল্প বিভিন্ন দেশে হচ্ছে। এসব প্রকল্প বাণিজ্যিকভাবে সফল হলে তখন এগুলো কাজে লাগবে। দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে, সে ব্যাপারেও সফলতা আসতে হবে। পরমাণুবিজ্ঞানে বাহাউদ্দিনকে সম্ভাবনাময় গবেষক হিসেবেই দেখছেন মো. শফিকুল ইসলাম।

নিজের দেশ বাংলাদেশের জন্য গবেষণা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে চান সৈয়দ বাহাউদ্দিন আলম। জানালেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তাঁর এই ছোট ছোট পারমাণবিক চুল্লিতে দুর্ঘটনার হার এখন পর্যন্ত ৪০ শতাংশ কমানো সম্ভব হয়েছে। এগুলো দিয়ে ১৫ থেক ২০ বছর পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। আরও ১৫ বছর পর নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরে আসতে চান। বললেন, ‘এ ধরনের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বাংলাদেশের জন্য অনেক কাজে আসবে।’