তাঁর তৈরি শাড়ি পরেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী
টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার থানার পাথরাইল উপজেলার চণ্ডী গ্রাম। এই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ তাঁতি। তাঁদেরই একজন রঘুনাথ বসাক। দীর্ঘ সময় ধরে তাঁতের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাঁদের সম্প্রদায়। দীর্ঘ সময় বলতে ৫০০ বছরেরও বেশি। রঘুনাথের যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোং নামের একটা বড় দোকান আছে। সেখানে তাঁরা তাঁতের শাড়ি আর থ্রি–পিস বিক্রি করেন। অনেকেই সেখান থেকে পাইকারি কিনে নিয়ে ব্যবসা করেন। রঘুনাথদের পূর্বপুরুষেরা থাকতেন বর্তমান ভারতের মুর্শিদাবাদে। সেখান থেকে তাঁতের জন্য সুবিধাজনক আবহাওয়ার খোঁজে তাঁদের একটা অংশ চলে আসে বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহীতে।
রাজশাহীতে আসা তাঁতিরা তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে যান। একটা অংশ ঢাকার তাঁতিবাজারকে কেন্দ্র করে বসত গড়ে। আরেকটা অংশ চলে যায় কিশোরগঞ্জ। তৃতীয় ভাগের মানুষেরা থিতু হন চাঁপাইনবাবগঞ্জে। যেসব তাঁতি কিশোরগঞ্জে ঘাঁটি গেড়েছিলেন, তাঁদের একটা অংশ প্রথমে আসে ঢাকার ধামরাই। এরপর সেখান থেকে তাঁদের আরেকটা অংশ আবার চলে যায় টাঙ্গাইলে। তাঁদের বংশধরদেরই একজন রঘুনাথ বসাক।
রঘুনাথের বাবা–দাদারা ব্যবসা করতেন জাহাজে আর নৌকায় চড়ে। টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা আর কলকাতায় তাঁতের শাড়ি আর কাপড় নিয়ে যেতেন। বাহাদুরাবাদ ঘাট থেকে জাহাজে চড়ে কলকাতার বাজার ধরতেন। আর এলাসিন ঘাট থেকে ধলেশ্বরী নদীতে জাহাজে বা নৌকায় চড়ে মাল নিয়ে যেতেন ঢাকায়। মাঝেমধ্যে বাই রোডেও যেতেন। আর এখন, বিশেষ করে করোনা মহামারির প্রথম ধাক্কার পর থেকে রঘুনাথের ব্যবসা ঢুকে গেছে হোয়াটসঅ্যাপ আর ইমোর ভেতর। নতুন কোনো শাড়ি বা থ্রি–পিসের কালেকশন এলে ছবি তুলে পাঠিয়ে দেন। পছন্দ হলে অর্ডার আসে। তারপর পাঠিয়ে দেন সেই ঠিকানায়। এভাবেই চলছে এখনকার ব্যবসা।
কেন এই এলাকায় ভালো তাঁত হয়? উত্তরে রঘুনাথ বলেন, ‘যমুনার পানি, আর্দ্রতা, আবহাওয়া...। যে পানিতে আয়রন, তাতে তাঁতের সুতা ধুলে সেই সুতা সুন্দর হয় না। যমুনার পানিতে আয়রন নেই। এই স্রোতের পানিতে তাঁতের সুতা খুব ভালো হয়। রং-ও পাকা থাকে।’
আপনি যদি কখনো টাঙ্গাইলে গিয়ে খুঁজে খুঁজে যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোং–এ যান, দেখবেন ক্যাশিয়ারের পেছনের দেয়ালে টাঙানো আছে দুটি ছবি। একটিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন। আরেকটিতে পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি।
শোনা যাক প্রথম ছবিটার গল্প রঘুনাথের মুখেই, ‘ছবিটা ২০১৬ সালে তোলা। তখন টাঙ্গাইলের এমপি ছানোয়ার হোসেন প্রধানমন্ত্রীকে আমাদের এখানকার একটা তাঁতের শাড়ি উপহার দেন। সেই শাড়ি পরেই প্রধানমন্ত্রী সংসদে জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন। এরপর তিনি শাড়ির বুননের প্রশংসা করে ওই তাঁতিকে পুরস্কৃত করতে চান। আমি তো জীবনে ছোটখাটো কিছু পুরস্কার পাইছি। তাই আমার ছেলে খোকন বসাক আর যে তাঁতি শাড়িটা বানাইছে, হুমায়ূন কবির, ওদের দুজনকে ঢাকা পাঠাই। ওরাই প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে গণভবনে পুরস্কারটা নেয়। সেই ছবি এটি।’
পরের ছবিতে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে যাঁকে পুরস্কার নিতে দেখা যাচ্ছে, তিনি রঘুনাথের ছোট ভাই। তিনি কলকাতায় তাঁদের পারিবারিক তাঁতের ব্যবসা পরিচালনা করেন। সেখানেই ভালো কাজের জন্য তাঁকে এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
রঘুনাথ বলেন, করোনার বিধিনিষেধের আগে যত তাঁতি এই ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন, এখন আছে তার তিন ভাগের দুই ভাগ। মহামারিসহ নানা কারণে এখন তাঁতশিল্পে চলছে মন্দা। অথচ এই এলাকার মানুষের প্রধান পেশাই এটি। যখন তাঁতশিল্পের বাজার ভালো চলে, তখন পাথরাইলের বাজারে মাছের দাম বেড়ে যায়। বেড়ে যায় মিষ্টির বিক্রি। এলাকার বাজার চাঙা হয়ে ওঠে।
তাঁতশিল্পকে আবারও চাঙা করার উপায়ও জানালেন রঘুনাথ। তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে মিডিয়া। মিডিয়া তাঁতশিল্পের প্রচার প্রসারকে অনেকটা দূর এগিয়ে নিতে পারে। আর সরকার যদি লোন দেওয়ার পাশাপাশি বাজারজাতকরণ আর পৃষ্ঠপোষকতায় সহায়তা করে, তাহলেও খুব ভালো হয় এই শিল্প আর শিল্পীদের। সরকারি, বেসরকারি অফিস–আদালতে যদি শাড়ি পরা উৎসাহিত করা হয়, তাহলেও বেড়ে যাবে শাড়ির কদর। ‘আমি কেবল তাঁতের শাড়ি পরার কথা বলছি না। যেকোনো শাড়ি পড়ুক। বাঙালি নারীদের শাড়ি পরার চল ফিরে আসুক। এটাই আমাদের চাওয়া,’ বলেন রঘুনাথ।