টাইলস দিয়ে যায় চেনা
ঘরের দেয়াল সাজাতে প্রাচীনকাল থেকেই পোড়ামাটির ফলকের চল ছিল। সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি দেয়ালের স্থায়িত্বও বৃদ্ধি করত সেই ফলক। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, এক হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দেও শুধু পোড়ামাটির ফলক নয়, সিরামিক টাইলসের চল ছিল। যদিও সেগুলোর আকার, আকৃতি, নকশা ছিল ভিন্ন। মিসর এবং চীনের প্রাচীন সভ্যতাগুলোতেও সিরামিক টাইলস ব্যবহারের নিদর্শন পেয়েছেন প্রত্নতত্ত্ববিদেরা।
বর্তমান সময়ে সিরামিক টাইলস তৈরি ও ব্যবহার প্রাচীন সময় থেকে বেশ আলাদা। শুরুর দিকে টাইলস বলতে শুধু বাড়ির ছাদে ব্যবহৃত খটখটে মাটির ফলককেই বোঝাত। হাতে তৈরি সেসব টাইলস শিল্পকর্ম হিসেবে আজও বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে টাইলসের গুণগত মান। নকশায়ও এসেছে ভিন্নতা। সর্বাধুনিক ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করেও এখন তৈরি হচ্ছে টাইলস।
টাইলসের যত ধরন
ধরনের ওপর নির্ভর করে কোন টাইলস কোথায়, কীভাবে ব্যবহার করা যাবে। বাজারে পাওয়া যায় এমন কয়েক ধরনের টাইলস হলো—
সিরামিক টাইলস
দেয়ালে ব্যবহারের জন্য সিরামিক টাইলসই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। ওজনে হালকা হওয়ায় এগুলো যেকোনো ধরনের দেয়ালে লাগানোর উপযোগী। বাজারে ছোট ও মাঝারি আকারের পাওয়া যায় এই টাইলস। দামও তুলনামূলক কম।
মিরর পলিশড টাইলস
আকারে বেশ বড় বলে এ ধরনের টাইলস মেঝেতে ব্যবহৃত হয় বেশি। চকচকে হওয়ার কারণে এই টাইলসে আলো প্রতিফলিত হয়ে ঘরের উজ্জ্বলতা বাড়ায়।
হোমোজিনাস টাইলস
হোমোজিনাস টাইলসও মেঝেতে ব্যবহার করা হয়। তবে মিরর পলিশড টাইলসের তুলনায় এর দাম বেশ কম। যাঁরা মেঝেতে বেশি বড় আকারের টাইলসের পরিবর্তে ছোট টাইলস ব্যবহার করতে চান, তাঁরা হোমোজিনাস টাইলস বেছে নিতে পারেন। একই উপকরণে পুরো টাইলস তৈরি হয় বলে এই টাইলস অনেক বেশি টেকসই এবং বেশি ভার বহন করতে পারে।
রাস্টিক টাইলস
এই টাইলসের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এগুলো দেয়াল ও মেঝে—উভয় জায়গাতেই ব্যবহার করা যায়। এর ডিজাইন বেশ আধুনিক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। এ জন্য বাড়ির বাইরের দেয়াল, বাগান, ছাদ, লনের মতো জায়গায় বেশি মানানসই। ছোট ও মাঝারি মাপে পাওয়া যায় বলে ব্যবহার সহজ হয়। বিশেষ করে বসার বা শোবার ঘরের যেকোনো এক পাশের দেয়ালকে সাজাতে রাস্টিক টাইলসের ব্যবহার বেশি দেখা যায়। এতে ঘরের শোভা বাড়ে।
ডেকোরেটিভ টাইলস
অন্য টাইলসের সৌন্দর্য বাড়াতে ডেকোরেটিভ টাইলসের ব্যবহার করা হয়। আলাদাভাবে এর তেমন কোনো ব্যবহার নেই বললেই চলে। বাজারে নানা ধরন, আকার ও আকৃতির ডেকোরেটিভ টাইলস পাওয়া যায় । বিশেষ করে রান্নাঘর, বাথরুম ও ছাদের সৌন্দর্য বাড়াতে অন্য টাইলসের সঙ্গে এটির ব্যবহার করা হয়। বাজারে বিভিন্ন ডিজাইনের পাশাপাশি বিশেষ কালার থিমের ডেকোরেটিভ টাইলস পাওয়া যায়।
লাপাটো টাইলস
অফিস, শপিং মল বা কারখানার বিশেষ জায়গায় ব্যবহার উপযোগী টাইলস হচ্ছে লাপাটো টাইলস। একে বলা হয় সেমি পলিশড টাইলস। আবার খসখসে টাইলস নামেও পরিচিত। সাধারণত বাণিজ্যিক স্থান বা পাবলিক প্লেসে লাপাটো টাইলস বেশি ব্যবহার করা হয়। কারণ, এগুলো খুবই মজবুত এবং দীর্ঘস্থায়ী। দীর্ঘদিন ব্যবহারেও থাকে অক্ষত। এই টাইলসও বিভিন্ন সাইজে পাওয়া যায়।
কোথায় কেমন টাইলস
টাইলস সহজেই ঘরের সৌন্দর্য বাড়ায়, এটি ঠিক। কিন্তু সঠিক জায়গায় সঠিক টাইল ব্যবহার করতে না পারলে ঘটবে বিপরীত ঘটনা। যেমন বাজারে বিভিন্ন ডিজাইনের, সাইজের অনেক রকম টাইলস পাওয়া যায়। আবার টাইলসগুলোর কাঁচামালেও রয়েছে ভিন্নতা। কোথায় কোন ধরনের টাইলস উপযোগী, নির্ভর করে সেই টাইলসের বৈশিষ্ট্যের ওপর এবং একই সঙ্গে ব্যবহারকারীর পছন্দের ওপর। টাইলসের রং নির্বাচনের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, একই বাসায় যেন নানা রঙের বা ধরনের টাইলস ব্যবহার করা না হয়।
শোবার ঘর
শোবার ঘর আরামের জায়গা। সেই দিকটা মাথায় রেখে শোবার ঘরে অপেক্ষাকৃত বড় ধরনের টাইলস ব্যবহার করুন। চোখ আরাম পাবে। জয়েন্ট কম থাকলে ময়লাও কম জমবে। শোবার ঘরের উজ্জ্বলতা বেশি চাইলে মিরর পলিশড টাইলস ব্যবহার করুন। একঘেয়ে ভাব দূর করতে চাইলে বা কিছুটা িভন্নতা আনতে চাইলে যেকোনো একটি দেয়ালে রাস্টিক টাইলস ব্যবহার করতে পারেন। রাস্টিক টাইলসের রং মেঝের টাইলসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাছাই করুন। দেয়ালের নিচ থেকে ছয় ইঞ্চি পর্যন্ত মেঝের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ টাইলস ব্যবহার করুন।
বসার ঘর
ড্রইংরুমে স্বল্প আলো খুবই বেমানান। তাই এখানে উজ্জ্বল রঙের টাইলস ও মিরর পলিশড টাইলস ব্যবহার করাই ভালো। পরিসর বেশি হলে বড় আকারের টাইলস মানানসই হবে। আজকাল অনেকে কাঠের টেকশ্চার খুব পছন্দ করেন। এমন হলে কাঠরঙের টাইলস লাগাতে পারেন। ভিন্নতা আনতে যেকোনো এক দেয়ালে রাস্টিক টাইলস ব্যবহার করতে পারেন।
ডাইনিং রুম
ডাইনিং টেবিলের পাশের দেয়ালে সিরামিক টাইলস ব্যবহার করাই ভালো। তবে তা হতে হবে ঘরের অন্য সব টাইলসের সঙ্গে মানানসই। সৌন্দর্য বাড়াতে চাইলে দেয়ালে ডাইনিং রুমের উপযোগী ডেকোর টাইলস ও বর্ডার টাইলস ব্যবহার করতে পারেন। মেঝেতে ড্রয়িংরুমের সঙ্গে মিল রেখে বড় আকারের টাইলস ব্যবহার করুন।
রান্নাঘর
রান্নাঘরের টাইলস নির্বাচন করতে হবে এর আকার অনুযায়ী। যেমন ছোট রান্নাঘরের মেঝেতে ছোট সাইজের টাইলস মানানসই। রঙের ক্ষেত্রে গাঢ় রং বেছে নেওয়াই ভালো। তাহলে সহজে ময়লা দেখা যাবে না। তবে ডাইনিং রুম থেকে রান্নাঘরের রঙের খুব পার্থক্য না করাই ভালো। দেয়ালে রান্নাঘরের সঙ্গে মানানসই ডেকোর ও বর্ডার টাইলস ব্যবহার করুন। দেয়ালে দিতে পারেন সিরামিক টাইলস, তেল চিটচিটে ভাব সহজেই দূর করা যাবে।
বাথরুম
রান্নাঘরের মতো বাথরুমের টাইলস নির্বাচনের ক্ষেত্রেও জায়গার আয়তন বিবেচনায় রাখতে হবে। ছোট মেঝেতে ছোট সাইজের টাইলস ব্যবহার করুন। দেয়ালে মেঝের সঙ্গে মানানসই ডিজাইনের সিরামিক টাইলস ব্যবহার করুন। পিচ্ছিল ভাব দূর করতে মেঝেতে হোমোজিনাস অথবা নন-স্কিড টাইলস বেছে নিন। সৌন্দর্য বাড়াতে দেয়ালে ডেকোর ও বর্ডার টাইলস ব্যবহার করা উচিত।
লিভিং রুম
আজকাল মাঝারি থেকে বড় অ্যপার্টমেন্টে, ড্রয়িংরুমের সঙ্গেই থাকে ফ্যামিলি লিভিং রুম। তাই লিভিং রুমের টাইলস নির্বাচনে ড্রয়িংরুমের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা উচিত। ফ্যামিলি লিভিং রুমে বিশেষ ধরনের থিম বা টেকশ্চারের টাইলস মানানসই। ফ্লোরে রাস্টিক টাইলসও বাড়তি সৌন্দর্য যোগ করবে। দেয়ালে রাস্টিক টাইলস লাগাতে পারেন, আলোর বিপরীতেও এগুলো ভালো দেখায়। বৃষ্টির পানি ও ধুলোবালু পারিষ্কার রাখার জন্য জানালার সিল লেভেলে মিরর পলিশড টাইলস ব্যবহার করা যেতে পারে।
টাইলস কেনার সময় সতর্কতা
টাইলস কেনার সময় অনেকগুলো বিষয় আলাদাভাবে মাথায় রাখতে হয়। এ জন্য টাইলস সম্পর্কে জ্ঞান আছে এমন কেউ সঙ্গে থাকলে ভালো। অন্যথায় নিজেই যাচাই করুন কিছু বিষয়। যেমন দুটি একই টাইলস পাশাপাশি নিয়ে রং ও শেপ মিলিয়ে নিন। মেঝের টাইলসের ক্ষেত্রে চারটি টাইলস পাশাপাশি রেখে কোনা ও জয়েন্ট মিলিয়ে নিতে পারেন। মিরর পলিশড টাইলসের ক্ষেত্রে আলোর প্রতিফলন হচ্ছে কি না, পরীক্ষা করতে লাইটের নিচে ধরে দেখতে পারেন। ঘরের ক্ষেত্রফল বিবেচনা করে ফ্লোর টাইলসের সাইজ নির্বাচন করুন। মনে রাখবেন বড় পরিসরে বড় টাইলস মানানসই।
সঠিক টাইলস কিনতে চাইলে কিছু প্রযুক্তিগত শব্দের সঙ্গে অবশ্যই আপনার পরিচিত হতে হবে। কেনার সময় এর ডিজাইন, সাইজ, কোয়ালিটি, ডেলিভারি সুবিধা, প্রয়োজনীয় পরিমাণ টাইলস আছে কি না, জেনে নিন। বিক্রয়–পরবর্তী সুবিধা কী পাবেন, সেটাও জেনে নিন।
আরও কিছু বিষয় জানতে হবে। তার মধ্যে একটি পানি শোষণক্ষমতা। একটি টাইলস পানির সংস্পর্শে এলে কত ভাগ পানি শোষণ করে, সেটাই টাইলসের পানি শোষণক্ষমতা। একটি টাইলস যত কম পানি শোষণ করবে, তা তত ভালো মানের টাইলস। মনে রাখতে হবে, বেশি পানি শোষণকারী টাইলস সহজে ভেঙে যেতে পারে, ধীরে ধীরে উজ্জ্বলতা হারায়।