ছুটিতে ফিরে যাই নিজের কাছে
‘ছুটি’ শব্দটার সঙ্গে কোথায় যেন ফুরফুরে আনন্দের যোগ আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ছুটি মানে কেয়াপাতার নৌকো গড়ে ফুলে ফুলে সাজিয়ে দেওয়ার অবসর। সত্যিই তো তাই! যা ভালো লাগে, যা মন চায়, সারা বছর ব্যস্ততার গ্যাঁড়াকলে পড়ে যা করতে পারি না, যা করার ফুরসত মেলে না, তা-ই যদি না করতে পারলাম তবে আর ছুটি কিসের? কিন্তু আমরা যেভাবে ছুটি কাটাই, তাতে নিজের মনকে মুক্ত করার সময় মেলে তো? সেখানে ক্ষণিকের মুক্তির স্বাদটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার ফুরসত থাকছে তো? নাকি ছুটিতেও মাথায় চেপে বসে আছে দায়িত্বের পাহাড়?
সমাজবিজ্ঞানের ভাষায়, বাঙালি সমাজ আদ্যোপান্ত কালেকটিভিস্ট বা দলবদ্ধ। আত্মীয়-বন্ধু পরিবেষ্টিত জীবনেই আমরা অভ্যস্ত। তাই বোধ হয় আমাদের ছুটি উদ্যাপনের আবহমান রেসিপিও দাওয়াত আর আড্ডাকেন্দ্রিক। আমাদের ছোট-বড় অধিকাংশ ছুটিই কেটে যায় সামাজিক নানা বাধ্যবাধকতায়। আমরা দল বেঁধে দাওয়াতে যাই, ভরপেট খাই, বন্ধুদের সঙ্গে জম্পেশ আড্ডা হয়, কেউ হয়তো বাড়িতেই অতিথি আপ্যায়নে সময় কাটাই। ঘুরতে গেলেও আমাদের সঙ্গে থাকে পুরো পরিবার আর দর্শনীয় স্থানের লম্বা তালিকা। বন্ধু-আত্মীয়পরিজনের সঙ্গে কাটানো এই সুন্দর সময়টুকু নিঃসন্দেহে ছুটির একটা বড় পাওয়া, কিন্তু এত কিছুর মধ্যে ‘নিজের জন্য’ সময় কোথায়?
প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘নিজের জন্য’ সময় কেন জরুরি? আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিয়ে যেখানে পুরো ছুটি কাটিয়ে ফেলা যায়, সেখানে কেন বলছি একা বসে কিছুক্ষণ বই পড়ুন, খোলা আকাশে চোখ রাখুন, যা ভালো লাগে করুন? এই প্রশ্নের উত্তরে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাপত্র বলছে, ‘মানুষ যখন “মি টাইম” বা নিজের সঙ্গে সময় কাটায়, তখন তা সত্যিকার অর্থে মানসিক ক্লান্তি দূর করে। কেননা “কে কী ভাবছেন”বিষয়ক ভাবনা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়া যায় শুধু নিজের উপস্থিতিতেই।’
শুধু হার্ভার্ডই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে সারা বিশ্বেই মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা যেমন বাড়ছে, নিজেকে সময় দেওয়ার গুরুত্ব নিয়ে ততই বাড়ছে আলোচনা ও গবেষণা। এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ফারজানা রহমানের বক্তব্য, ‘আমাদের সমাজে “একা” থাকার বিষয়টিকে বেশ নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। কাউকে একা দেখলেই আমরা ভাবি “নিঃসঙ্গ”, কিন্তু আপনার একা থাকার সময়টি নিজেকে মূল্যায়নের, নিজেকে উদ্যাপনেরও হতে পারে।’
কিছুদিন আগে ইলমী তাবাসসুম নামের এক বন্ধু ফেসবুকে লিখেছিল, ‘একটু নিজের জন্য সময় চাই। বেশি না। এক-দুদিন।’ আমরা যাঁরা ঢাকার মতো যান্ত্রিক শহরে থাকি, যানজট যাঁদের অর্ধেক দিন খেয়ে ফেলে, ইলমীর মতো একটু নিজের পাশে বসার আকুতিটা যেন তাদের আরও বেশি। ক্লান্তি কাটানোর জন্য, সৃজনশীলতা ও কাজের উদ্যম ফিরে পাওয়ার জন্যও নিজের সঙ্গে সময় কাটানো ভীষণ জরুরি।
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আবীর চৌধুরী যেমন বলছিলেন, ‘পুরো সপ্তাহই কাটে ট্রাফিক জ্যামের সঙ্গে যুদ্ধ করে। তাই বোধ হয় ছোটবেলার দুপুরগুলোর মতো একটু শান্ত হয়ে বসতে ইচ্ছা করে খুব। যা-ই করি না কেন, কোনো রকম ব্যস্ততা ছাড়া গান শুনতে শুনতে সময় কাটানোর ওই এক টুকরো অবসরটাই আসলে আমার কাছে ছুটি!’ আবীরের মতো ‘ছোটবেলার দুপুরে’ ফিরতে চাই আমরা অনেকেই। নানা ব্যস্ততায় আমরা ইদানীং ভুলে যাচ্ছি কী করতে ভালোবাসতাম, কী হতে চাইতাম। এই আমার কথাই ধরুন। ছোটবেলায় ভেবেছি, বড় হলে হোমওয়ার্ক থাকবে না, মাটিল্ডার মতো বই পড়ব একটানা। আর বড় হয়ে দেখছি ছুটির দিনগুলো হয়ে যাচ্ছে ঘরের কাজ করার আর দাওয়াতে যাওয়ার উপলক্ষ। ‘পড়তে চাই কিন্তু সময় পাচ্ছি না’ তালিকাভুক্ত বইয়ের স্তূপ দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে তাই একদিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি ছুটিতে নিজের জন্য আলাদা সময় রাখব। সেই আলাদা সময়টুকুতে শুধু মন যা চায়, তা–ই করব। মন চাইলে আবার না হয় ৩০তম বারের মতো মিসির আলি অমনিবাস–এই ফেরত যাব, তবু মনের কথা ফেলব না।
মনের কথা শুনেই বছর চারেক আগে ছুটিতে একা ভ্রমণ করতে শুরু করেছিলেন বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত জোশিতা শারলিন খান। বহির্বিশ্বে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই ‘সলো ট্রিপ’ বা ‘একাকী ভ্রমণ’–এর বিষয়টি বেশ জনপ্রিয় হলেও আমাদের দেশে নারীদের একা ভ্রমণের বিষয়টিতে এখনো জড়িয়ে আছে অনেক দ্বিধা, প্রশ্ন। তবে সেসব প্রশ্ন আর দ্বিধা পাশ কাটিয়েই জোশিতা প্রথমবার ভ্রমণে গিয়েছিলেন ভারতের পন্ডিচেরিতে। সেই অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন তিনি, ‘মুক্তির আনন্দ বলে একটা কথা আছে না? প্রথমবারের একা ভ্রমণে নিজের পরিকল্পনা, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়া থেকে আমি সেই মুক্তির আনন্দ পেয়েছিলাম। কোথাও ঘুরতে গেলে নতুন জায়গা দেখা হয় তো অবশ্যই, কিন্তু সেবার ছুটিতে আমি নিজেকেও নতুন করে আবিষ্কার করেছিলাম।’
আবার জোশিতার চেয়ে সম্পূর্ণ উল্টো উপায়ে ছুটিতে ‘মি টাইম’ কাটানোর গল্প বললেন উদ্যোক্তা ও কনটেন্ট ক্রিয়েটর হাবীবা আক্তার, ‘আমি ঘর সাজাতে ভীষণ ভালোবাসি, মনের মতো করে নিজের বাসা সাজিয়েছিও। অথচ কাজের চাপে বাসায় থাকার ফুরসতই পাই না। লম্বা ছুটি পেলে আমি তাই ঘরের সবচেয়ে প্রিয় কোণটায় বসে যাই। কখনো সেখানে বসে নিজের যত্ন নিই, কখনো আবার সেখানে বসেই ছবি আঁকি। ঘরের কাছে ফেরাই আমার জন্য নিজের সঙ্গে সময় কাটানোর মুহূর্ত।’
রিডার্স ডাইজেস্ট ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদনে লিখেছিল—নিজের যত্ন বা সেলফ কেয়ারের জন্যও নিজের সঙ্গে সময় কাটানো জরুরি। কিন্তু সেলফ কেয়ার মানে আপনার কাছে কী—সেটা ঠিক করতে হবে আপনাকেই। কেউ হয়তো পারলারে গিয়ে ফেশিয়াল করানোকে সেলফ কেয়ারের অংশ ভাবেন। কেউ আবার ঘরে বসেই গান শুনতে শুনতে বা গাইতে গাইতে চুলে তেল দিয়ে নিজের যত্ন নেন। শুধু রূপচর্চা বা চেহারার যত্ন নেওয়াই আবার সেলফ কেয়ার নয়, মনের যত্ন নেওয়ারও আছে নানা রকম উপায়। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকে কর্মরত সিমিন ইবনাত যেমন বলছিলেন, ‘ভাবনাহীন ছুটির দিনে আমি যখন নিজের জন্য এক কাপ চা বানাই, সেটিও আমার জন্য সেলফ কেয়ার।’
নিজের সঙ্গে সময় কাটানোর আসলে তেমন কোনো ধরাবাঁধা ফর্মুলা নেই। সে সময়টুকু যেমন আপনার নিজস্ব, সময় কাটানোর উপায়গুলোও হতে পারে তেমনই নিজস্ব। দারুণ কোনো বই পড়ে ফেলতে হবে, বিখ্যাত সব সিনেমা দেখে ফেলতে হবে—এমন তাড়া নিয়ে নয়, বরং যা করলে আপনার ভালো লাগবে, মন ফুরফুরে হবে, তা-ই করুন। সহযোগী অধ্যাপক ফারজানা রহমানও বললেন সে কথাই, ‘নিজের সঙ্গে সময় কাটানোর অর্থ হলো নিজের মুখোমুখি হওয়া। হতে পারে কিছুই না করে, হয়তো মিষ্টি রোদে শুধু বসে থেকে আপনি কিছুক্ষণ নিজের কথা, আপনার স্বপ্নের কথা, লক্ষ্যের কথা, ভালো লাগার কথা, খারাপ লাগার কথা ভাবছেন। এই ভাবনাটা কিন্তু নিরর্থক নয়, এই ভাবনাটার মাধ্যমে আপনি নিজেকে মূল্যায়ন করছেন, উদ্যাপন করছেন।’
ফারজানা রহমানের কথা শুনতে শুনতে আমি নিজেই ফিরে গেলাম কিছু না করার অবসরে। মনে হলো, মফস্বলের বারান্দায় রোদ গড়াগড়ি খাচ্ছে আজও। কিন্তু ‘ফিরব ফিরব’ বলে আর ফিরছি না বহুদিন। অথচ সেখানে গা এলিয়ে বসে থাকার স্বপ্ন দেখেছি আজীবন। এই লেখা লিখতে লিখতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবার সত্যিই এবং শিগগিরই ছুটিতে একবার প্রিয় বারান্দায় ফিরে যাব। ফিরতে পারেন আপনিও। নিজের কাছে, প্রিয় সবকিছুর কাছে। ছুটি তো আসছেই, শুধু একটু সময় বের করে নিজের মুখোমুখি হয়েই দেখুন এবার!