বিশ্ব কফি দিবসের বিশেষ আয়োজন
এ সুবাস ছড়িয়ে গেছে সবখানে
বাঙালি কফিপ্রেমের ইতিহাস যত পুরোনোই হোক, তার স্বরূপটা আজকের মতো ছিল না। বরং আবালবৃদ্ধবনিতার প্রিয় ছিল চা। সেই জায়গা আস্তে আস্তে দখল করে নিয়েছে কফি। তৈরি হয়েছে নতুন সংস্কৃতি। ক্রমেই কফিপ্রেমীরা শিখে যাচ্ছে কফির সহবত।
আশির শেষ থেকে নব্বইয়ের দশকে যখন ইংরেজি কিংবা হিন্দি ভালো গানের ক্যাসেট রেকর্ড করতে চাচ্ছি, তখন আমাকে বলা হলো বিশেষজ্ঞের কাছে সঠিক দোকানে যেতে হবে।
যেমন? যেতে বলা হলো রেইনবো, সুর বিচিত্রা কিংবা রিদম-এ।
লোকেশন? এলিফ্যান্ট রোডের কফি হাউসের গলি!
আজ থেকে ২০-২২ বছর আগের কথা, তখনো কিন্তু কফি-সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। কফি হাউস সেই সময়ে ছিল প্রায় বিদেশি একটা আদবকায়দা।
নব্বইয়ের শেষে নেসক্যাফে এল আমাদের এজেন্সিতে—কফির বিজ্ঞাপন করবে। তখনো কফি খাওয়াটা হচ্ছে কেতাবি বিষয়। দাওয়াতে গেলে বা মিটিংয়ে বসলে জিজ্ঞেস করা হতো: ‘চা খাবেন? না হলে ঠান্ডা কিছু দিই?’ অর্থাৎ হয় চা, নতুবা কোমলপানীয়। এজেন্সির সিনিয়র ‘ভাবিস্ট’ টাইপের ক্রিয়েটিভ লোকজন কফি নেন, কিংবা ক্লায়েন্ট এলে বসের রুম থেকে এনে কফি দেওয়া হয়। ক্লাবে মিটিংয়ে বসলে কফি চলতে পারে; কিন্তু কাজের ফাঁকে আড্ডা মারতে গেলে ওই চা-ই ভরসা। আমরা গবেষণায় দেখলাম, এই দেশে তখন প্রতি ১ হাজার কাপ চা চললে ১৮ কাপ কফি চলে। অথচ আমাদের বলা হলো, কফির প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ানোর জন্য প্রচার আয়োজন করতে।
প্রচারে প্রসার
‘চলো সবাই’ গানটা মনে আছে? টুকটাক নানান বিজ্ঞাপন দু-এক বছর চালানোর পর এই গানটা দিয়ে নেসক্যাফে বাংলাদেশি সংস্কৃতির সঙ্গে কফিকে মাতিয়ে তুলল। বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেলটিতে ঘুণাক্ষরেও কফি খেতে বলেনি, কিন্তু অবচেতনে ঠিকই উৎসবের সঙ্গে কফি মিশে গেল। একই সঙ্গে কফিকে আস্তে আস্তে সহজলভ্য করে তোলা হলো। দাম কমল, দোকানের শেলফে জায়গা পেল, বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় কফি মেশিনে কফি বানানো শুরু হলো।
ফলাফল? ২০০০-এর প্রথম দশকে দাওয়াতে গেলে বা মিটিংয়ে বসলে জিজ্ঞেস করা শুরু হলো: ‘চা, কফি, না কোমলপানীয়?’ অতএব জায়গা করে নিল কফি আমাদের দৈনন্দিন কথাবার্তায়।
কফি হাউস থেকে কফিশপ
২০০০-এর মাঝামাঝি আমরা এমজিএইচ গ্রুপে খুব চাইছিলাম দেশে কফিশপের (সনাতনী ইংরেজিতে বলে কফি হাউস) ব্যবসা তৈরি করতে। স্টারবাকস আনতে চাইলাম; দেশজুড়ে ৬৩ জেলায় জেএমবি বোমা ফাটাল, স্টারবাকস গেল ভয়ে পিছিয়ে। শেষ পর্যন্ত আনা হলো বারিস্তা। ইতালিয়ান অরিজিন, ভারতীয় পরিচালিত চেইনশপ।
এই বারিস্তা ছিল ঢাকার প্রথম সঠিক কফিশপ। কফি হাউসের যে ধরাছোঁয়ার বাইরের একটা ব্যাপার ছিল, বারিস্তা এসে সেটা ভেঙে দিল। সকাল ৮টা থেকে খোলা, সকাল সকাল ঘুম-ঝেড়ে-ফেলা-কফি দিয়ে দিন শুরু। ঝকঝকে আলোময় খোলামেলা ক্যাফে, ঢুকলেই কফি বিনের গন্ধটা মৌতাত বোনে। মনে হলো বিদেশের একটা টুকরো দেশেই।
চাকরিজীবীরা, বিশেষত ব্যাংকার, বহুজাতিক কোম্পানির নবীন কর্মকর্তারা, ব্যবসায়ীদের দ্বিতীয় প্রজন্ম—এঁরা কফিশপে আসা শুরু করলেন। ঢাকার নতুন শহর, ট্রাইস্টেট এলাকায় (গুলশান+বনানী+বারিধারা এলাকা একটা আলাদা দুনিয়া) বারিস্তা একাধিক ছোট দোকান খুলে ফেলল, সঙ্গে ধানমন্ডির আউটলেটটা তো আছেই। বিদেশি ভাবের ফাইভ স্টার হোটেল কিংবা রহস্যেঘেরা কফি হাউসের থেকে এবার কফি চলে এল নবীন করপোরেটের হাতে।
প্রায় সমসাময়িক সময়ে এসেছিল কফি ওয়ার্ল্ড ট্রাইস্টেট এলাকায় এরপর এক ধাপ উঁচুতে এল গ্লোরিয়া জিনস। অস্ট্রেলিয়ার সাধারণ একটা কফি চেইনশপ, নাভানা গ্রুপ বাংলাদেশে এনে আলিশান সুবিশাল জায়গা নিয়ে হলো ‘ফ্ল্যাগশিপ স্টোর’। গ্লোরিয়া জিনস কফির সঙ্গে পুরোদস্তুর বিদেশি এবং ফিউশন খানার ব্যবস্থা করে দেওয়ায় কফিসংস্কৃতি আরও শক্তিশালী হলো।
দেখতে দেখতে এলো ক্রিমসন কাপ, তাবাক এবং আরো অনেকে।
আমার সবচেয়ে প্রিয় কফি স্টোর এল সবশেষে। নর্থ এন্ড। বিদেশি মানুষ, বাংলাদেশে বউয়ের চাকরির জন্য এসেছিলেন, বেকার বসে না থেকে শুরু করলেন কফি বিনের আমদানি, সেখান থেকে মনে হলো একটা ছোট ক্যাফেই দিয়ে দেওয়া যায়। বাড্ডার একটি অপ্রত্যাশিত জায়গায় ঘরোয়াভাবে শুরু হয়ে আজকে নর্থ এন্ডের সম্ভবত ৮টি আউটলেটে চলছে। ঘরোয়া, আপন একটা দোকান, একই স্ট্যান্ডার্ডের কফি প্রতিটি দোকানে, প্রতিবার, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্ররা বারিস্তা (যারা কফি বানায়)। নবীন এবং তরুণ প্রজন্মের করপোরেটদের জন্য এখন এটা এক টুকরো গল্পের জায়গা।
করপোরেট এবং কফি–সংস্কৃতি
কফি-সংস্কৃতির একটা বড় অংশই কিন্তু হচ্ছে করপোরেট জীবন। সকালে যাওয়ার সময় একটা কফি, অফিসের ফাঁকে একটা ছোট ‘কফি ব্রেক’ (এখন কিন্তু ‘চা-আড্ডা’ আর নেই), ব্যবসায়িক আলাপের জন্য কফি-মিটিং, কিংবা লম্বা দিনের শেষে সহকর্মী, বন্ধু বা ভালোবাসার মানুষটার সঙ্গে কফি খেতে যাওয়া। কর্মদিবসের প্রায় প্রতিদিনই একাধিক কাপ কফি চলছে।
কাজের জায়গায় কফি এখন এতটাই চালু যে একটা সময় শুধু কফি চলত; এখন অফিসে মিটিংয়ে গেলে আপনার ব্ল্যাক কফি, রেগুলার কফি উইদাউট সুগার, কফি উইথ কফিমেট কত কি চলে!
তবে, আমরা কতটুকু কফি বুঝি?
কফি শুরু হয়েছিল কিন্তু ইথিওপিয়া থেকে। কফি বিন আসে কফি ফল থেকে। ইথিওপিয়া থেকে কফি ছড়িয়ে পড়ে আরবজুড়ে। আরব থেকে কফি যখন ইউরোপে যায়, তখন সেখানে বিশেষত ইতালি, স্পেন এবং ফ্রান্সে—এটা প্রায় জীবনের অংশ হয়ে ওঠে। জনপ্রিয়তার ফলে আরব থেকে আমদানি করা কফির অভাব পড়ে। ইউরোপীয়রা তখন ইন্দোনেশিয়ায় গিয়ে কফির চাষ শুরু করেন। ঔপনিবেশিকতার তিনটি প্রধান বাণিজ্য ছিল দাস, কফি এবং চিনি।
কফিশপগুলোর কল্যাণে আমাদের কফি শেখা
- এসপ্রেসো - শুধুই কফি (কোনো পানি বা দুধ নেই), সাধারণত ছোট কাপে দেয়
- মাকিয়াতো - এসপ্রেসোর সঙ্গে খানিকটা দুধ
- ক্যাপুচিনো - এসপ্রেসোর সঙ্গে ফেনায়িত দুধ
- ক্যাফে লাতে - ১:১ কফি এবং দুধ
- ক্যাফে মোকা - ক্যাফে লাতের সঙ্গে চকলেট বা সে রকম মিষ্টি কিছু
- ক্যাফে আমেরিকানো - এসপ্রেসোর সঙ্গে অনেকটুকু পানি
আবার নানা কফিতে নানা ফ্লেভার দেওয়া যায়। যেমন ক্যাপুচিনোতে একটু হেজেলনাট সিরাপ দিয়ে হয়ে যায় হেজেলনাট ক্যাপুচিনো, ক্যাফে লাতেতে ভ্যানিলা সিরাপ যোগ করলে হয় ভ্যানিলা লাতে ইত্যাদি।
এখনো আমরা শিখছি। আমরা দিনের নানান ভাগে নানা কফি খাই। ইতালিয়ানরা ১১টার পর ক্যাপুচিনো বা লাতে (দুধ দেওয়া কফি) প্রায় খায়ই না। ফ্রান্সে প্রায় সব জায়গায় কফি বললে এসপ্রেসো দেবে। আমেরিকায় আবার আমেরিকানো দেবে। বাংলাদেশে সাধারণত দুধ দেওয়া একটা সংস্করণ দেবে। আমরা কফিতে মিষ্টি চাই, এ জন্য ‘ফ্লেভারড’ কফি ভালো চলে।
ঢাকার বাইরে কফি
ঢাকার ভেতরে আরেকটা ঘরানার কফির দোকান তৈরি হয়েছে। ‘আপন কফি হাউস’ যেমন। এঁরা কফির কিছু দেশি সংস্করণ তৈরি করেন। দুধ, চিনি এবং কফিমেটের নানান কম্বিনেশনে অনেক দোকান সুস্বাদু কফি তৈরি করে এবং সেটা খুবই ভালো চলে। মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় এমন দোকান পাবেন, পাবেন মাটিকাটা পার হয়ে অথবা মিরপুর ডিওএইচএসের পথে।
তবে ঢাকায় কফির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে কফিশপগুলোর কারণে। ঢাকার বাইরে সেভাবে প্রসারটা হয়নি। জেলা শহরগুলোতে এখনো নেসক্যাফের মেশিনে বানানো কফির চল প্রচুর, কিন্তু ক্যাপুচিনো কিংবা এসপ্রেসো পাওয়া কঠিন। আমার মনে হয়, বারিস্তার অপ্রতুলতা, বিনিয়োগের রক্ষণশীলতা এবং উদ্যোক্তার সমন্বয়—এই তিনের জন্য ঢাকার বাইরে কফির চল কম।
কফি সবাইকে কাছে আনে, কফি নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গ দেয়
আসলে, আজকের প্রজন্ম খানিকটা অস্থির। অপ্রাপ্তি প্রচুর। সবার সঙ্গে মানিয়ে চলার প্রবণতাও প্রবল। আমাদের আজ সময় কম। আমরা আয় বেশি করি, নিজেকে খুশি রাখতে কিংবা প্রবোধ দিতে ব্যয় করতে পিছপা হই না।
আমরা, দেশীয়রা, কফির বিষয়ে কম বুঝি; কিন্তু এখন আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটা আমাদের আয়ত্তের ভেতর চলে এসেছে। ফলে আড্ডা মারতে এখন কফি শপ। সময় নেই তো ১৫-২০ মিনিটে খানা খাওয়ার জন্য কফিশপ। মন ভালো নেই, একলা সময় প্রয়োজন, একটা কফি নিয়ে স্বচ্ছ কাচের পাশে বসে ব্যস্ত শহরে নির্জনতা খুঁজে পাই।
বারিস্তা: কফি বানান যিনি
কফি যিনি তৈরি করেন, তাঁকে বারিস্তা বলে। ভাল, সঠিক মাত্রায় দুধ ও পানি মিশিয়ে কফি তৈরি করাটা বেশ কঠিন কাজ। এর জন্য ভাল বারিস্তারা ৩ মাস পর্যন্ত ট্রেনিংয়ে থাকতে পারেন। তবে সঠিক কফি বানানোটা বারিস্তার প্রথম ধাপ। প্রতিটি বারিস্তা এক একজন শিল্পী, এক একজন সঙ্গী। তিনি কফিতে যেমন ছবি আঁকেন, তেমনি তিনি আপনাকে প্রতিদিন দেখতে দেখতে চেনেন। আপনার সঙ্গে কোনো কিছু কমন পড়লে হয়তো একদিন কফির সঙ্গে চকলেট সিরাপ দিয়ে কিছু একটা লিখে দিল; আবার হয়তো বৃষ্টির দিনে আপনাকে ক্যাফে-লাতের বদলে একটা মাকিয়াতো দিল। ভালো কফিশপ সব সময় বারিস্তাকে ক্ষমতা দিয়ে রাখে কাস্টমারের জন্য একটা ফ্রি কফি তৈরির।
এ রকম একজন বারিস্তা তৈরি করতে যে মেধার প্রয়োজন হয় তার জন্য নর্থএন্ড প্রথম চালু করল বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্রদের সম্মানজনক বেতনে বারিস্তা হিসেবে নিয়োগ করা। আজকে অনেক কফিশপই এই কাজটা করছে। বারিস্তাদের আয় এখন অফিসের এক্সিকিউটিভদের সমান। প্রতিটি কাজ সম্মানের, এতে কোনো সংকোচের কিছু নেই, এটা এই প্রজন্ম বুঝে নিয়েছে। অন্যদিকে, সপ্রতিভ মেধাবী ছেলেমেয়েরা আসার ফলে আমরা পাচ্ছি সাধারণের চেয়ে বেশি সেবা।
ঢাকায় এ রকম বারিস্তা কয়েকটি ক্যাফেতেই হয়েছে। আমি এঁদের অনেকেই দেখেছি যে ওই এক কাপ কফিতে তাঁর সমস্তটুকু ঢেলে পরিবেশন করতে। মন খারাপ করা আপাটাকে কফির ফেনার ওপর সুন্দর একটা ময়ূর এঁকে দিয়ে যখন কাপটা এগিয়ে দেয় একজন বারিস্তা, তখন মন ভালো করা যে হাসিটা সে পায়, সেটা অনেক কিছুর চেয়ে অনেক বড় পাওয়া।
লেখক: সফল উদ্যোক্তা, কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব, সার্টিফায়েড কফি টেস্টার ও খাদ্যরসিক