জ্যোতির্ময় তনিমা

করোনার দুঃসময়েও বাংলাদেশের তরুণেরা মেলে ধরছেন নিজেদের। নতুন বাস্তবতায়, নতুন উদ্যমে এগিয়েৃ চলছেন। জানান দিচ্ছেন তারুণ্যের অমিত শক্তি। বাংলা নববর্ষে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় তরুণ, যাঁরা এরই মধ্যে দেখিয়েছেন প্রতিভার স্বাক্ষর, তাঁদের নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে ‘ছুটির দিনে’। ১৪২৮ বঙ্গাব্দেও উজ্জ্বল এমন তরুণদের হাজির করেছে ‘ছুটির দিনে’। যার মধ্যে বিজ্ঞানে আছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী তনিমা তাসনিম

তনিমা তাসনিম

২০১৭ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের সায়েন্স নিউজ-এর কাছ থেকে এক বার্তা পেলাম। সে বছরে ৪০ বছরের নিচে ১০ জন বিজ্ঞানীর মধ্যে আমাকে যুক্ত করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে দুটি ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে গেল—১. সায়েন্স নিউজ একটা বড় ভুল করেছে; ২. যেহেতু আমি পেয়েছি, এই সম্মাননা নিঃসন্দেহে খুব সহজলভ্য!

২০২০ সালের সায়েন্স নিউজ ঘাঁটতে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ। বিজ্ঞানী তনিমা তাসনিম, যাঁকে সবাই অনন্যা নামে জানে, তাঁকে সায়েন্স নিউজ ২০২০ সালের ১০ জন উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞানীর একজন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আরও গর্বের ব্যাপার হচ্ছে, তিনি বাংলাদেশি। মাত্র ২৯ বছর বয়স। সামনে পড়ে আছে অসীম সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ।

ড. তনিমা পদার্থবিদ। আমি নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পদার্থবিজ্ঞানে দুটি ক্লাস নিয়েছিলাম। বিষয়টা এতই দুর্বোধ্য ও রসকষহীন ছিল যে টেনেটুনে পাস করে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। খুশি হয়েছিলাম যে জীবনে আর পদার্থবিদ্যা পড়তে হবে না। তারপরও সেদিন বাংলাদেশি এক বিজ্ঞানীর সাফল্যের কথা জানতে তনিমা তাসনিমের কাজ সম্পর্কে বোঝার চেষ্টা করলাম। সহজ ভাষায়—তাঁর কাজ মহাকাশের ক্রিয়া পদ্ধতি সম্পর্কে নতুন তথ্য এবং মতবাদ প্রদান করতে সহায়ক হতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে সায়েন্স নিউজ সম্পর্কে ধারণা পুরোপুরি বদলে গেল। সায়েন্স নিউজ-এর এই সম্মাননা অবশ্যই বেশ দুর্লভ। ২০১৭ সালে ওরা আমাকে এই সম্মাননা দিয়ে ‘ভুল’ করলেও তনিমা নিঃসন্দেহে সায়েন্স নিউজ-এর এই বিরল স্বীকৃতির যোগ্যতাসম্পন্ন এবং অসীম সম্ভাবনাময়।

তনিমা তাসনিম কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে নতুন তথ্য আবিষ্কার করেছেন। প্রশ্ন করতে পারেন, কৃষ্ণগহ্বরটি কী? কৃষ্ণগহ্বর হচ্ছে যেকোনো ছায়াপথের প্রাণকেন্দ্র। কৃষ্ণগহ্বরের মাধ্যাকর্ষণ এতই জোরালো যে এমনকি আলোও ওখান থেকে প্রতিফলিত হতে পারে না। তাই কৃষ্ণগহ্বর আমাদের আপাতদৃষ্টির বাইরে। কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে কোনো তথ্য জানতে হলে বিশেষ টেলিস্কোপ ব্যবহার করে একটা আনুমানিক ধারণা করতে হবে। এই রকম টেলিস্কোপের বেশ কয়েকটি ডেটাসেট নিয়ে যখন ড. তনিমা গবেষণা শুরু করলেন, সঙ্গে সঙ্গে এল বড় এক বাধা। টেলিস্কোপ থেকে পাওয়া তথ্য সব কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে জানার জন্য অপ্রতুল।

তাহলে উপায়? এখানেই তনিমা একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করে অন্য সব পদার্থবিদের চেয়ে অনন্য হয়ে রইলেন। কম্পিউটারবিজ্ঞানের একটি শাখা হচ্ছে মেশিন লার্নিং। এই শাখার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কম্পিউটারকে কোনো কিছুর উদাহরণ শিখিয়ে দিলে সে নিজে নিজে বাকিটা শিখে ফেলে। তবে মেশিন লার্নিং শেখা খুব সহজ নয়। দক্ষতা থাকতে হবে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, গণিত ও পরিসংখ্যানে। পদার্থবিদ্যার শিক্ষার্থী হয়েও তনিমা খুব দ্রুত মেশিন লার্নিং ব্যবহার করতে শিখলেন। মেশিন লার্নিংয়ের অ্যালগরিদমকে টেলিস্কোপ থেকে পাওয়া তথ্য দিয়ে নতুন মডেল তৈরি করলেন। মডেলটি আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সব কৃষ্ণগহ্বরকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে (অ্যাস্ট্রোফিজিকস) ২০১৭ সালের আগে কেউ এই সমস্যা সমাধানে মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি ব্যবহার করেননি। পদার্থবিদ্যায় সর্বশেষ প্রযুক্তির সমন্বয়ে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোতেই আছে তনিমা তাসনিমের সাফল্যের রহস্য।

শিক্ষার ধরন ইদানীং বেশ পাল্টে গেছে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, নকশা, কলাতত্ত্ব, চিকিৎসা—সবকিছু মিলেমিশে একাকার। শিক্ষাব্যবস্থাকেও দেওয়া হচ্ছে ‘ঘোঁটা’। কাউকে একটি নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে না ফেলে এক ‘জগাখিচুড়ি’ শিক্ষাব্যবস্থায় ফেলা হচ্ছে পরবর্তী প্রজন্মকে। ড. তনিমা তাসনিম এই ‘জগাখিচুড়ি’ শিক্ষাব্যবস্থার এক সফল উদাহরণ।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টারের কম্পিউটারবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক