স্বাধীনতার অর্ধশতক ও আমাদের অর্জন

ফাইল ছবি

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে রাষ্ট্রের গঠন ও উৎপত্তি এক যুগান্তকারী ঘটনা। রাষ্ট্র গঠনের রাজনৈতিক তত্ত্ব ও সামাজিক-বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নিয়ে দার্শনিকদের নানা মতবাদ রয়েছে। মানব সমাজের ইতিহাস এক শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। জ্য জ্যাক রুশো বলেছেন, ‘মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করলেও সর্বত্র সে শৃঙ্খলার কবলে আবদ্ধ। কোনো মানুষ চিরকাল শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়ে থাকতে চায় না। সব মানুষই নিজের স্বকীয়তা বজায় রেখে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে চায়।’

একটি জাতি দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তৈরি হয়। সৃষ্টি হয় তার ভাষা ও সংস্কৃতি। জাতি গঠনের একক এবং একমাত্র উপাদান হিসেবে ধর্ম বিবেচিত হতে পারে না। তৎকালীন পাকিস্তানেও তা বাস্তব রূপ পায়নি। মাত্র ২৩ বছরের মাথায় ধর্মের খোলস থেকে বেরিয়ে এসে বাঙালি তার নিজস্ব সত্তা ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়।

স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাস স্থান–কাল পাত্রভেদে ভিন্ন হয়। জাতি হিসেবে আমরা খুবই সৌভাগ্যবান যে অতি অল্প সময়ে স্বাধীনতা পেয়েছি। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বুকে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বাঙালি জাতি আত্মবিকাশ লাভ করে। যার স্বপ্নবীজ রোপিত হয়েছিল একাত্তরের ঐতিহাসিক ৭ মার্চে সমগ্র জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত ভাষণের মাধ্যমে। স্বাধীন জাতি হিসেবে এ বছর এ জাতি অর্ধশতক পেরোল।

আইনের শাসনের ঘাটতি এবং সর্বস্তরে দুর্নীতির দুষ্টচক্র রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি খাতকে করেছে প্রকৃতই পঙ্গু, যা আমাদের অন্যান্য সব অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে অনায়াসে। দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে সরকারকে আরও বেশি দৃঢ়-কঠিন কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে, যা এখন সময়ের দাবি

৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রিয় এ দেশ। এ দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখি বুদ্ধিজীবীসহ আরও অসংখ্য শ্রেণি-পেশার সাধারণ মানুষের ঘাম–রক্তে অর্জিত এই দেশ। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে আমাদের সময় এসেছে ফিরে দেখার, যে মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে সেদিন আমরা চেয়েছিলাম একটি স্বাধীন পুণ্যভূমি, বীর শহীদেরা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে, এ দেশ কি তা দিতে পেরেছে? কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে আমরা কি পৌঁছাতে পেরেছি?

ফাইল ছবি

১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বার্ষিক বাজেট আজ পরিণত হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেটে। সেদিনের ১২৯ ডলার মাথাপিছু আয়ের দেশটিতে বর্তমান মাথাপিছু আয় ২০৬৪ ডলার। সময় পেরিয়েছে, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও এগিয়েছে। আমাদের বৃদ্ধি এবং প্রবৃদ্ধি সময় ও প্রত্যাশার সঙ্গে সংগতি রেখেই ঊর্ধ্বগতি পেয়েছে। মাথাপিছু আয়, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে দৃশ্যমান পরিবর্তন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি, বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও ব্যবহার এবং সম্পদ উৎপাদন ও আহরণ দৃশ্যমান হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, সে কথা নির্মোহভাবেই বলা যায়।

বাংলাদেশ এখন এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ১৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকারে গত দুই যুগে সিঙ্গাপুর ও হংকংকে ছাড়িয়ে আজকের অবস্থানে উঠেছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাপী মহামারির কারণে যেখানে দেশে দেশে প্রবৃদ্ধির গতি ব্যাহত হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের ওপরে রয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং মধ্যম আয়ের দেশে পদার্পণ করেছে।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দেড় যুগে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রগতি তুলনামূলক বেশি দেখা গেছে। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু রোধ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকে উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। শ্রমশক্তিতে কর্মক্ষম মানুষের অংশ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় বেশি। দেশে সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৭ শতাংশ।

সরকার এসডিজি এবং জাতীয় অঙ্গীকারের ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৬-২০২০) প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে চলেছে। যার মধ্যে সাক্ষরতা বিস্তার, দক্ষতা উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টিতে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

বিগত কয়েক বছরে জনগণের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৯ সালে দাঁড়িয়েছে ৭২.৩ বছর। প্রাথমিক পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার কমে যাওয়ায় শিক্ষার হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯ পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ছিল ২২,৫৬২ মেগাওয়াট, দেশের ৯৪ শতাংশ জনগণ এখন বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে।

প্রথম আলো ফাইল ছবি

আইসিটি খাতে রপ্তানি বিষয়টি অবাস্তব মনে হলেও ২০১৯ সালে আইসিটি খাতে রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যান্য রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। রেমিট্যান্স আয় ১৬০০ কোটি মার্কিন ডলার। খাদ্যে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে অনেক আগেই। ২০১৯ সালে দেশের খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৪ কোটি মেট্রিক টন। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বৈদেশিক বিনিয়োগ ছিল ৩৬০ কোটি ডলার, যা উন্নয়নের আরেক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত।

গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে রাজধানীতে ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মেট্রোরেল স্থাপন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, যা ১৬টি স্টেশন ঘণ্টায় প্রায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা রাখবে। বাঙালির স্বপ্নের সেতু ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু’র কাজ প্রায় সমাপ্তির পথে, যা নিজস্ব বাজেটেই সম্পন্ন হচ্ছে। বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মহাকাশে ‘বঙ্গবন্ধু ১’ স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে বাংলাদেশ। যেকোনো সময় জরুরি ভিত্তিতে সেবা পেতে আধুনিক বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও চালু হয়েছে ইমার্জেন্সি সার্ভিস ‘৯৯৯’ কল সেবা। এ ছাড়া জনগণের সেবাদানে অন্যান্য কল সেবাগুলো চালু হয়েছে; দুদক, নারী নির্যাতন বা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, সরকারি তথ্যসেবা, স্বাস্থ্য বাতায়ন, দুর্যোগের আগাম বার্তা, জাতীয় পরিচয়পত্র তথ্য ও মানবাধিকার সহায়ক কল সেন্টার। এসব তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতে বলা যায়, একটি দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে একটি আধুনিক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবেই পালন করছে বলে প্রতীয়মান হয়। তবে বাস্তবিক অর্থে একটি দেশের প্রকৃত সমৃদ্ধি বা অগ্রগতি নির্ভর করে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকের ওপর, যা সাধারণত পরিসংখ্যানের নজর কাড়তে পারে না। জনগণের জীবনযাত্রার বাস্তব রূপ, ব্যক্তিগত ও সামাজিক নিরাপত্তা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, জীবনমুখী-কর্মকেন্দ্রিক মানসম্মত শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও গবেষণা, কর্মসংস্থান প্রভৃতি বিষয়গুলো উন্নয়নের প্রকৃত চিত্র প্রদর্শন করে।

ফাইল ছবি

স্বাধীনতার অর্ধশতক পরে একদিকে যেমন মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে অন্যদিকে সমাজে শ্রেণিবৈষম্য বেড়েছে সাগর সমান দূরত্বের বহরে। প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতি কিংবা মাথাপিছু আয় অর্থনৈতিক সক্ষমতার সূচক হলেও আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রভাবে বাংলাদেশের সমাজেও ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েছে, বেড়েছে সামাজিক অস্থিশীলতা এবং নিরাপত্তাহীনতা।

দেশের আর্থিক খাতের দুটি দুষ্ট খাত হলো খেলাপি ঋণ ও অর্থ পাচার। এ দুটির মধ্যে আবার পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ২০২০–এর সেপ্টেম্বরের শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। তালিকার শীর্ষে থাকা ২৫ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮০ হাজার ৩৫০ কোটি ৪২ লাখ টাকা। যার মধ্যে ৪২ হাজার ২২১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পাঁচ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের। অর্থ পাচার রোধে দেশে শাস্তির বিধান থাকা সত্ত্বেও কেন এ পাচার বন্ধ হচ্ছে না, তা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা জরুরি। বস্তুত, দুর্নীতি বেড়েছে বলেই অর্থ পাচারের হারও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এসব দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা রাজনীতির ঘনিষ্ঠ সহযোগী।

রাজস্ব খাতে আয়েও সরকারের দুর্বলতা সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয়। প্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধি না হওয়ার বড় কারণ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাঁদের আয় গোপন করছেন। সরকারি হিসাবে দেশে কোটিপতি নাগরিকের সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি হলেও কর প্রদানের সংখ্যা এক শও নয়। দেশের এক বিরাটসংখ্যক জনগোষ্ঠী কর-জালের আওতায় নেই। তারা ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে কালোটাকা সাদা করে কর ফাঁকি দিচ্ছে। এর জন্য দেশের দুর্নীতিবাজ কর প্রশাসন দায়ী।

দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা আজও সম্ভব হয়নি। ভেজাল খাবার খেয়ে প্রতিবছর তিন লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ক্যানসারসহ বিভিন্ন মরণব্যাধিতে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে বিভিন্ন কর্মসূচি ও আইন প্রণয়ন হলেও এর বাস্তবায়ন হতাশাজনক। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং শক্তিশালী বিরোধী রাজনৈতিক দলের সহাবস্থান একটি দেশে গণতান্ত্রিক অবস্থা বিরাজের অন্যতম সূচক। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশে যখনই কোনো দল ক্ষমতায় থাকে বিরোধী দলের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণই যেন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। অপর পক্ষে বিরোধী দলও গঠনমূলক সমালোচনা করে দেশ ও জনসাধারণের উন্নয়নে অংশগ্রহণ না করে নিজেদের আখের গোছাতেই অধিকতর মনোযোগী হয়েছে, যা দৃষ্টান্তমূলকভাবে জাতীয় রাজনীতির অপচর্চারই নামান্তর। রাজনৈতিক অপচর্চাকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিতে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন ভুঁইফোড় এবং পুরোনো রাজনৈতিক সংগঠন। স্বাধীনতা–উত্তর সব সরকারই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এই ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে আশ্রয় এবং প্রশ্রয় দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশকে ঠেলে দিয়েছেন নিমজ্জিত অন্ধকারের দিকে, এ কথা বললে অত্ত্যুক্তি করা হবে না মোটেই। বিগত বছরে নাসিরনগর, রামু ও সম্প্রতি সিলেটে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক হামলার চিত্র দেখে এ কথা সহজেই বলা যায়।

স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি কোনো সরকারই বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের জীবনমুখী মানসম্মত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার কথা ভাবেননি। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে এ+ গুণেই আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে সাফল্য নির্ধারণ করি। শিক্ষাব্যবস্থায় জিপিএর পরিমাণকে মানদণ্ড বিবেচনা করা নিরেট বোকামি ও জাতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বলে অভিমত দিচ্ছেন শিক্ষাবিদেরা।

আমাদের উচ্চশিক্ষার অবস্থা আরও বেহাল। দুঃখজনক হলেও সত্য যে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের প্রথম আট শ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হয়েছে। গত ২০ বছরেও উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা হয়নি, নেই কোনো সৃষ্টিশীলতা। এ ক্ষেত্রেও অসুস্থ রাজনীতিকেই দায়ী করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। দলীয়করণের প্রভাবে যখন নিয়োগ, পদোন্নতি হয়, তখন প্রকৃত মেধাবীদের মূল্যায়ন করার পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।

স্বাস্থ্য খাতে শিশুমৃত্যু এবং মাতৃমৃত্যুর হার কমলেও স্বাস্থ্যসেবায় প্রতিজন ডাক্তারের জন্য জনগণের সংখ্যা ২ হাজার ৫০০, যা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। এ ছাড়া সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য সরবরাহ পর্যাপ্ত ও আধুনিক প্রযুক্তিগত নয়, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত নার্সও নেই। ফলে সামর্থ্যবানেরা দেশের বাইরে উন্নত চিকিৎসা নেন এবং বাকিদের কপালে চিকিৎসাহীন মৃত্যুই শ্রেয়তর বলে বিবেচিত হয়।

ফাইল ছবি

আমাদের প্রবৃদ্ধির একটি বড় চালিকা শক্তি বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রেরিত অর্থ, যা দেশের জাতীয় আয়ের ৫ শতাংশের বেশি। যদিও তার পুরোটাই মধ্যপ্রাচ্যনির্ভর। মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরছেন বাংলাদেশি শ্রমিকেরা। মধ্যপ্রাচ্যপ্রবাসী কর্মজীবী নারীর ওপর যৌন হয়রানিসহ নানা বৈষম্য চলছে বছরের পর বছর ধরে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে মাত্র ৩ বছরে ৩১১ নারী শ্রমিক লাশ হয়ে ফিরেছেন, তাঁদের মধ্যে ৫৩ জনই আত্মহত্যা করেছেন, যা সরাসরি শ্রম অধিকার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত। এসব অভিযোগের প্রামাণিক তথ্যাদি থাকা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে এযাবৎ কোনোরূপ ইতিবাচক উদ্যোগ গৃহীত হয়নি।

লিঙ্গবৈষম্যের বিষয়ে দালিলিক অগ্রগতি সাধিত হলেও সর্বস্তরের নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি উন্নয়নে সরকার আরও গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে স্মরণকালের ইতিহাসে সর্বোচ্চসংখ্যক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২০১৯ সালে। প্রকৃত সংখ্যার মাত্র ১২ শতাংশ মামলা হলেও তার মাত্র ৩ শতাংশের বিচারিক রায় হয়েছে এবং ন্যায়বিচার রয়ে গেছে সুদূরপরাহত। বিগত বছরের বহুল আলোচিত ধর্ষণের ঘটনাগুলো সরকারের বড় ব্যর্থতার মাইলফলক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের করাপশন পারসেপশনস ইনডেক্স (সিপিআই) অনুযায়ী, দুর্নীতির বিশ্বজনীন ধারণাসূচকে বাংলাদেশের অবস্থা দুই ধাপ পিছিয়েছে। সিপিআই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৮০টি দেশের মধ্যে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় নিচের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। সূচকে উচ্চক্রম (ভালো থেকে খারাপের দিকে) অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আসেনি। এবারও ১৪৬তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।

আইনের শাসনের ঘাটতি এবং সর্বস্তরে দুর্নীতির দুষ্টচক্র রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি খাতকে করেছে প্রকৃতই পঙ্গু, যা আমাদের অন্যান্য সব অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে অনায়াসে। দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে সরকারকে আরও বেশি দৃঢ়-কঠিন কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে, যা এখন সময়ের দাবি।

পৃথিবীতে কোনো জাতি চিরকাল ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকতে চায় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসও তার ব্যতিক্রম নয়। মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, প্রতিরক্ষা এবং শিক্ষা বৈষম্য থেকে মুক্তি পেতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিল। একটি স্বাধীন দেশের কাছে তাই জনগণের প্রত্যাশাও শ্রেণিহীন শোষণমুক্ত সমাজের।
স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। আমাদের স্বাধীনতা রক্ষা ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে দেশের সুশীল সমাজসহ রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক জনগণের অংশগ্রহণে দেশ পরিচালনার কাজ করতে হবে। প্রকৃত গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে ভয়হীন সমাজ গঠনের নিমিত্তে উদারনৈতিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। মানবিক সমাজ গঠনই পারে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে নিতে। মহান স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি এবং জাতির জনকের জন্ম শতবর্ষে আসুন অঙ্গীকার করি একটি দুর্নীতিমুক্ত সুন্দর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার।

*লেখক: সঙ্গীতা ইয়াসমিন, টরন্টো, কানাডা।