খচখচানি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

খচখচানি এক অনিরাময়যোগ্য ব্যাধি। দুর্বোধ এই ব্যাধির শিকার হই প্রায়ই। আহত করে, ধূলিসাৎ করে পুরো দিন অথবা সপ্তাহকে। বহুবার ব্যর্থ হয়েছি অবিরাম এই খচখচানির কারণ এবং জাগতিক পথ্য খুঁজতে গিয়ে। তবে ছোটখাটো এক কিংবা একাধিক ‘অস্বস্তিকর ঘটনা’ ঘটলে লাঘব হয় দুর্বিষহ এই খচখচানি। স্বস্তি মেলে। খানিকটা অনাহুত বিলম্বের দরুন বিমান আমাকে রেখেই যখন উড়ল, তখন গত কয়েক দিনের অবিরাম খচখচানির কিঞ্চিৎ মীমাংসা হলো ভেবে প্রশান্তিতে ডুব দিয়েছিলাম। ছয় ঘণ্টা পর পরবর্তী বিমান উড়বে। অর্থ পরিশোধে মিলবে নতুন টিকিট, নতুবা নয়। কিন্তু পকেট ছিল শূন্য। ক্রেডিট কার্ডগুলো তছনছ করে সর্বোচ্চ মিলল চায়ের পয়সা।

ইস্তাম্বুল থেকে বিমানে ঘণ্টারও কম দূরত্বের ইজমিরে গিয়েছিলাম ভূমিকম্পে আহত বন্ধু তুরানের হাল হকিকত জানতে। তাগাদা ছিল দিনের আলোয় আবার ইস্তাম্বুলে ফেরার। তুরান আমার অত্যন্ত প্রিয়জন, দুর্দিনের বন্ধু। আদর্শিক জমিন আমাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন দুনিয়ার যাত্রীতে পরিণত করলেও বন্ধুত্ব পরিপক্ক হয়েছে পরস্পরের দুনিয়াকে জানার আগ্রহ থেকে। তুরান নামাজ, রোজার পাশাপাশি আত্মস্থ করেছে কামালবাদ। আধুনিক জাতিরাষ্ট্রব্যবস্থা তুরানের অনুরূপ কোটি কোটি মানুষের জন্ম দিয়েছে, যেখানে ধর্ম আর ফ্যাসিবাদ মিলেমিশে একাকার। তবে আজকের আলাপ তুরানকেন্দ্রিক নয়।

এক বন্ধুর অছিলায় ত্বরিত অর্থের জোগান হলো। বন্ধু আমার দুর্গতি ঠাওর করে, উপোস ঠেকাতে প্রত্যাশার চেয়ে খানিকটা অতিরিক্ত অর্থ পাঠিয়েছিলেন। নতুন টিকিটের অনুসন্ধানে নেমে পড়লাম। কাউন্টারে আসীন স্বর্ণকেশী মুখে স্মিত হাসি ধরে রেখে পাসপোর্টের মলিন ছবিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। স্বর্ণকেশীর স্মিত হাসি মুহূর্তেই এক জটিল হাসিতে রূপান্তরের ঘটনা আমাকে অত্যন্ত লজ্জিত করলেও মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে গুছিয়ে নিতে সমর্থ হয়েছিলাম। তবে বিচলিত ভাবটা বিরাজমান ছিল সম্ভবত। স্বর্ণকেশী বিনা মূল্যে ফিরতি টিকিট দিয়েই থামলেন না, বরং ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর থেকে ছাত্রাবাস পর্যন্ত একটি ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দিলেন। বিষয়টি আর্থিক সামর্থ্যের প্রশ্ন নয়। ঝামেলাটা ছিল অন্যত্র এবং সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য। বিনা মূল্যে এ অনাকাঙ্ক্ষিত সেবা গ্রহণে আমার স্পষ্ট গোঁয়ার্তুমির দরুন স্বর্ণকেশী দীর্ঘদিন ইস্তাম্বুলে বসবাস এবং মাঝেমধ্যেই যাত্রার নিমিত্তে টার্কিশ এয়ারলাইনস ব্যবহারকে একটি সরস উত্তর হিসেবে হাজির করলেন, যা কোনোভাবেই আমাকে সন্তুষ্ট করেনি।

করোনা মহামারির ক্রমাগত দুর্দশা পূর্বোক্ত ঘটনার হতবিহ্বলতা ভুলিয়ে জীবনে আপন গতি এনেছে। সদ্য গত হওয়া ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষ দিন। প্রচণ্ড তুষারময় দিনে যান্ত্রিক জীবনের অবসাদ ও দুশ্চিন্তা দূর করতে ইস্তাম্বুলের হেইবেলি দ্বীপের পথ ধরেছিলাম। মর্মর সাগরের অসম্ভব বৈচিত্র্যপূর্ণ এ দ্বীপের নীল পানি, পাহাড় আর নীরবতা মুহূর্তেই সুস্থ করে তুলতে পারে মানুষকে। হেইবেলিতে পৌঁছালাম দুপুরে। সূর্যহীন দুপুর। এক দিকে বসফরাসের পানি, অন্য দিকে হেইবেলির শুভ্র পাহাড়। পানি আর পাহাড় মিলেমিশে একাকার। নিরাকার এই মিহি সৌন্দর্যের শেষ সাক্ষী হয়েছিলাম সম্ভবত কায়রোতে। তুষারের দরুন সন্ধ্যা নামার পরও চারদিক বেশ উজ্জ্বল ছিল। শেষ জাহাজ ধরার মনস্থির করে আগেভাগেই জাহাজঘাটের পথ ধরলাম। জাহাজঘাটে আচমকা সাক্ষাৎ মিলল বহুকালের পুরাতন বন্ধু আহনেকের। দিন, মাস আর বছরের হিসাবে প্রায় সাত বছর চার মাস। দৈবক্রমে আঙ্কারায় আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল এক ভয়াবহ তুষারের দিনে। তুষারের দিনেই আবার দেখা, কী অদ্ভুত! আলাপের শুরুতেই আহনেক জানালেন, কায়রোয় ইজিপ্টোলজিতে স্নাতকোত্তর পড়তে গিয়ে কীভাবে ইজিপ্টোলজির কাছে পরাজিত হয়েছেন। ইজিপ্টোলজির কোর্স ওয়ার্ক শুরু করার পূর্বে বছরব্যাপী প্রাচীন মিসরীয় ভাষাগুলো আয়ত্ত করতে হয়। প্রাচীন এসব ভাষার গূঢ় রহস্য সমাধানের পথে খেই হারিয়েছিলেন আহনেক। কিন্তু মনোবল ধরে রাখতে ইজিপ্টোলজি ত্যাগ করে নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তরের একটি সনদ নিয়েই ইস্তাম্বুলে সদ্য ফিরেছেন। কায়রো, নীলনদ, আসওয়ান এবং আলেকজান্দ্রিয়াবিষয়ক আলাপ-আলোচনা এতটাই শক্তিমান ছিল যে আমাদের যৌথ অতীত স্পর্শের সুযোগ হয়নি।

ঘটনার এক সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয়েছে। আবার তুষারে ধবধবে সাদা হয়েছে চারদিক। যথারীতি জানালার পাশে আসন গেঁথে তুষার দেখছিলাম। নিস্তব্ধতা আর তুষারপাত মিলে যথারীতি একটি চমৎকার সকাল। প্রকৃতির এই প্রশান্তভাবকে গুড়িয়ে দিয়ে এক অচেনা পথিক আর ছাত্রাবাসের নিরাপত্তারক্ষী সুনগুরকে আলাপরত দেখলাম। লম্বা ভুঁড়িওয়ালা সুনগুরে আমার ভক্তি এবং বিশ্বাসে ঘাটতি আছে। সুনগুরের চাহনিতে, আলাপে, ব্যবহারে বর্ণবাদের গন্ধ স্পষ্ট। তাই আগত অতিথিকে নয়, বরং শান্ত প্রকৃতির মধ্যে অশান্তির জন্য সুনগুরকে দায়ী করলাম। খানিক পরে একটি নীল রঙের প্যাকেট নিয়ে দরজায় হাজির সুনগুর। প্রেরক ছিলেন আহনেক। আহনেক সাত বছর চার মাস আগেই নতুন জীবনের পাল তুলেছিলেন। চমৎকার আর মিহি সৌন্দর্যের আহনেক বন্ধুমহলে দুর্দান্ত প্রতাপ, উচ্চস্বরে অপছন্দের নিন্দা এবং দারুণ সব নতুন চিন্তার জন্য আদায় করে নিয়েছিলেন প্রবল সুখ্যাতি। তুরস্কের নামিক কামাল, শরিফ মারদিন থেকে শুরু করে আজিজ নেসরিনের মতো দুর্দান্ত চিন্তকদের চিন্তায় আহনেকের যতটা দ্রুত ও কার্যকর যোগাযোগ ছিল, ঠিক ততটাই দখল ছিল মার্ক্স, ওয়েবার কিংবা সাবা মাহমুদ এবং আশিস নন্দীতে। স্বল্পভাষী ঝরঝরে কথাবার্তায় পারদর্শী আহনেকের শরীরের রং প্রতিফলিত হয়েছে মননে ও চিন্তায়।

গত শতাব্দীর শেষ দিকে সম্ভবত ১৯২০ থেকে ১৯২৫ সালের কোনো একসময়, আহনেকের দাদাভাই নিশাপুর থেকে হিজরত করে থিতু হয়েছিলেন ইস্তাম্বুলে। আহনেকের পরিবারের একটি বিশাল অংশ আজও নিশাপুর নিবাসী। বছরান্তে নওরোজ উৎসবে নিশাপুর গমন তাই আহনেকের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নিশাপুর, ইরান আর আহনেকের পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে আমাদের আলাপ মাঝেমধ্যেই মধ্যরাতে থামত। আবার বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা নানান রাজনৈতিক সভায় একসঙ্গে হাজিরা দিতাম। সময়ের ব্যবধানে চমৎকার এক বোঝাপড়া সৃষ্টি হয়েছিল। তবে আঙ্কারার শেষ সাক্ষাতে তাঁর খোঁজ না নেওয়ার একমাত্র আর্জি আট বছর ধরে আমি নির্ভীকভাবে পালন করে আসছি। দীর্ঘ এক চিঠি লিখেছেন আহনেক।

ভাষায় ছিল অটোম্যান আর রিপাবলিকান আমলের টার্কিশের মিশ্রণ। চমৎকার কিছু ফারসি শব্দ চিঠির মাধ্যমে বর্ণিত আহনেকের আকাঙ্ক্ষা এবং অনুতাপসম্পর্কিত অতীতকে জীবিত করেছিল ক্ষণিকের জন্য। সঙ্গে সঙ্গে চিঠি পরিষ্কার করল যে আহনেক আমার সব বিষয়ে সবজান্তা। ইজমির বিমানবন্দরে বিনা মূল্যের টিকিট, ট্যাক্সির ব্যবস্থাসহ আহনেক নানান কায়দায় উপস্থিতি বজায় রেখেছেন। আসন্ন বিয়ে, পরিবার আর বর্তমানের টার্কিশ এয়ারলাইনসের এক গবেষণার কর্মকর্তার কাজ নিয়ে আহনেকের জীবন সুখ-সাচ্ছন্দ্যের জোয়ারে টইটম্বুর। তবে এ জোয়ারের গতিধারার স্থায়িত্ব সম্পর্কে স্পষ্ট ভাষণ চিঠিতে অনুপস্থিত ছিল। পরিণত, একনিষ্ঠ সোহাগ, যত্ন কিংবা নিখাদ বন্ধুত্ব আমরণ স্মৃতিতে তাজা থাকে। দেশ, মহাদেশ কিংবা মহাকাশে পাড়ি দিলেও অত্যন্ত মূল্যবান এ সম্পদ মানুষকে মানসিকভাবে শক্তি যোগায়। দুর্দিন ভুলে থাকতে সহায়হতা করে। বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত কার্যকর এ পথ্য মানুষকে স্বপ্ন দেখায়। নারী সম্ভবত অতীত স্মৃতির লালন–পালনে অন্যদের চেয়ে দক্ষ।

আহনেকের কলমে তার একটি প্রগাঢ় ছোঁয়া ছিল। আন্দাজ বলে, সুখ স্পর্শ করেনি আহনেককে। চমৎকার আর্থিক সাচ্ছন্দ্য করুণ বেদনাবহ জীবনে রং দিতে পারেনি। আজ আবার ইজমিরে এসেছি। সন্ধ্যার আগেই ফিরতে হবে ইস্তাম্বুলে। ইচ্ছা করেই বেশি সময় নিয়ে বিমানবন্দর ত্যাগ করছি। নীরবে চোখ বুলিয়ে নিয়েছি চারদিকটায়। আহনেকের শব্দ খুঁজে ফিরছি। না, তাঁর দেখা পাওয়া গেলও না। মাথায় ঘুরছিল জীবনানন্দ দাশের ‘স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়, হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়! আমি তারে পারি না এড়াতে’ লাইনগুলো।