মঞ্চে উঠল তাসমিনা। মুহুর্মুহু করতালি। বিজয়ীর বেশে হাত উঁচু করে দাঁড়াল সে। প্রধান অতিথি তাসমিনার হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন। সে দুই হাত বাড়িয়ে পুরস্কারের প্যাকেট নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল। আবার করতালি। ঘোড়দৌড়ে পুরুষদের সঙ্গে লড়ে প্রথম হয়েছে তাসমিনা। মঞ্চ থেকে নামতেই ঘোড়ার মালিক এসে হাজির। সব পুরস্কার ঘোড়ার মালিককে দিয়ে খালি হাতে ধীরে ধীরে মেলাপ্রাঙ্গণ ত্যাগ করে তাসমিনা। দুই বছর ধরে অন্যের ঘোড়া জিতিয়ে দিয়ে এভাবেই খালি হাতে বাড়ি ফেরে সে। শুধু বিজয়ের আনন্দটুকু তার।
তাসমিনার বাড়ি নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার চকসুবল গ্রামে। বাবার নাম ওবায়দুর রহমান। তাসমিনা শঙ্করপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। তার আছে ঘোড়া ছোটানোর নেশা। প্রতিযোগিতায় খেলার মতো ঘোড়া নিজের নেই। তবু নেশার কারণে যেখানেই ঘোড়দৌড়ের আয়োজন হয়, তাসমিনা বাবার সঙ্গে সেখানেই যায়। অন্যের ঘোড়া জিতিয়ে দেয়। পুরস্কার যা পায়, ঘোড়ার মালিককে দিয়ে দিতে হয়। সহৃদয় কোনো মালিক তাদের যাতায়াত ভাড়াটা দেন। তবু মেয়ের শখের কারণে বাবা চুপ থাকতে পারেন না। কোথাও প্রতিযোগিতা হবে শুনলেই মেয়েকে নিয়ে ছোটেন।
২ জুন ঘোড়দৌড়ের আয়োজন করা হয়েছিল রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কাঁকনহাট পৌর এলাকার রসুলপুর মহল্লার ডানকিপাড়া মাঠে। স্থানীয় ব্যবসায়ী আতাউর রহমান এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন কাঁকনহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল মজিদ। প্রতিযোগিতায় ২৫টি ঘোড়া অংশ নেয়। পাঁচ দলে প্রতিযোগিতা হয়। পুরুষদের সঙ্গে তিনটি দলে অংশ নিয়ে তাসমিনা তিন দলেই প্রথম স্থান অধিকার করে। পুরস্কার হিসেবে তার হাতে তিনটি মুঠোফোন তুলে দেওয়া হয়। আতাউর রহমান বলেন, ‘আমাদের গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা সব বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।’ নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্যই তাঁরা এই মেলার আয়োজন করেছেন। ভবিষ্যতেও করবেন।
প্রধান অতিথি আবদুল মজিদ জানান, তাসমিনা মেয়েটি অবিশ্বাস্য গতিতে যেভাবে ঘোড়া ছোটাল, সেটা দেখার মতো দৃশ্য। আবার চলন্ত ঘোড়ার পিঠ থেকে সে যেভাবে হাজার হাজার দর্শকের উদ্দেশে হাত নাড়ল, সেটা দেখেও সবাই মুগ্ধ হয়েছে। আবদুল মজিদ বলেন, ‘তিন দলেই প্রথম হওয়ার জন্য আমরা তাকে তিনটা মুঠোফোন এবং একটি বালতি দিয়েছি। পরে জানলাম, মেয়েটির নিজের ঘোড়া নেই। পুরস্কারগুলো সে পায়নি। তখন মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটার এ এক বেদনাদায়ক বিজয়।’
তাসমিনার বাবা ওবায়দুর রহমান জানান, তাঁরও ছিল ঘোড়ার শখ। ছোট একটা ঘোড়াও তাঁর ছিল। দেখতে দেখতে মেয়ে একদিন ওই ঘোড়ায় চড়ে বসে। দিনে দিনে ওর ভয় ভেঙে যায়। অভাবের কারণে সেই ঘোড়া তিনি বিক্রি করে দেন। এক বছর আগে স্থানীয় লোকজন মেয়ের ঘোড়া চালানোর প্রতিভা দেখে বাকিতে ময়মনসিংহ থেকে ২০ হাজার টাকায় একটি ঘোড়া কিনে দেয়। এ পর্যন্ত তিনি তাঁর পাঁচ হাজার টাকা শোধ করতে পেরেছেন। ওবায়দুর জানান, দুই বছর আগে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে মেয়েকে নিয়ে প্রতিযোগিতায় যান। একটি ঘোড়া জিতিয়ে দিয়ে মেয়ে একটি টেলিভিশন পুরস্কার পেল। কিন্তু ঘোড়ার মালিক সেই পুরস্কার নিয়ে নিলেন। মেয়ের মন খারাপ হয়ে গেল।
তারপরও যেখানেই প্রতিযোগিতা হয়, মেয়েকে ওবায়দুর ধরে রাখতে পারেন না। ঘোড়া জিতিয়ে টেলিভিশন, কম্পিউটারসহ অনেক পুরস্কার পেয়েছে মেয়ে। কিন্তু বাড়ি ফেরার সময় খালি হাতে ফিরতে হয়। এবার পাবনায় এক মাস থেকে বিভিন্ন জায়গায় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। সব জায়গায় মেয়ে প্রথম হয়েছে। তিনি জানান, টাঙ্গাইলের আবুল ড্রাইভার সবচেয়ে বড় ঘোড়া চালান। ঘোড়ার পেটের নিচ দিয়ে হেঁটে পার হওয়া যায়। তাঁর মেয়ে সেই ঘোড়াও চালিয়েছে। ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে বসে হাত ছেড়ে দিয়ে দর্শকদের আনন্দ দেয়। সবাই হাততালি দেয়। এ বছর মেয়ে প্রায় ২০টি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে।
ওবায়দুর রহমান জানান, এখন প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে একমুঠো ভাত খেয়ে ঘোড়ার পিঠে ওঠে। দুপুরে এসে দুটো খেয়ে আবার ঘোড়া নিয়ে বের হয়। সারা দিন ঘোড়ার পিঠেই থাকে। তার একটা বড় ঘোড়া চাই। তিনি বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। ঘরভিটে ছাড়া কিছু নেই। কৃষি কাজ করি। বড় ঘোড়ার দাম ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। আমি কোথায় পাব। মেয়ে বোঝে না। এ জন্য প্রতিযোগিতায় নিয়ে যাই। মেয়ে মানুষের বড় ঘোড়া চালায়। পুরস্কার না পেলেও বড় ঘোড়া চালানোর আনন্দটা পায়।’
জীবনের স্বপ্ন কী—জানতে চাইলে তাসমিনা বলে, ‘আমার নিজের একটা বড় ঘোড়া চাই। আর কিছু না।’