ফেলে দেওয়া নয়, দুধের সমাধান উন্নত প্রযুক্তিতে
দেশে একদিকে মানুষের দুধ পানের পরিমাণ খুব কম, অন্যদিকে খামারি পর্যায়ে প্রায়ই দুধ ফেলে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এর একটা সমাধান হতে পারে উচ্চ তাপমাত্রা বা আলট্রা হাই টেম্পারেচার (ইউএইচটি) পদ্ধতিতে প্রক্রিয়া করে দুধ বাজারজাত করা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, ইউএইচটি পদ্ধতিতে প্রক্রিয়া করা দুধ ছয় মাস খাওয়ার উপযোগী থাকে। এটি দুধ প্রক্রিয়াকরণের সর্বাধুনিক পদ্ধতি। এ দেশে তিনটি কোম্পানি এখন এ পদ্ধতিতে দুধ প্রক্রিয়া করে বাজারে ছাড়ছে। দিন দিন এ বাজার বড়ও হচ্ছে।
কোম্পানিগুলো বলছে, ইউএইচটি পদ্ধতিতে কাঁচা দুধকে ১৩৫ থেকে ১৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় চার সেকেন্ড উত্তপ্ত করে সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত অবস্থায় ছয় স্তরবিশিষ্ট টেট্রাপ্যাকের বিশেষ কার্টন প্যাকে বাজারজাত করা হয়।
ইউএইচটি প্রক্রিয়ায় দুধে থাকা রোগ ও পচন সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া এবং পচনকারী উৎসেচক (এনজাইম) শতভাগ ধ্বংস হয়ে যায়। টেট্রাপ্যাকের কার্টন ভেদ করে কোনো ধরনের বাতাস, আর্দ্রতা ও সূর্যের আলো প্রবেশ করে না। তাই নতুন কোনো ব্যাকটেরিয়া দুধের সংস্পর্শে আসতে পারে না। ফলে প্যাকেটজাত দুধ সাধারণ কক্ষ তাপমাত্রায় (২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ছয় মাস পর্যন্ত পানের উপযোগী থাকে। এটি বিশ্বে ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রচলতি একটি পদ্ধতি।
অন্যদিকে পাস্তুরীকরণ প্রক্রিয়ায় কাঁচা দুধকে ৭২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১৫ সেকেন্ড উত্তপ্ত করা হয়। এতে দুধে উপস্থিত ১০০ ভাগ রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু ছাড়াও ৯০ শতাংশ পচনকারী ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হয়। ফলে দুধ মানুষের পানের জন্য নিরাপদ হয়ে যায়। কিন্তু পাস্তুরীকরণের সাত দিনের মধ্যেই দুধে অবশিষ্ট ১০ শতাংশ ব্যাকটেরিয়া পচনক্রিয়া শুরু করে। এতে রেফ্রিজারেটরে রাখার পরও দুধ পানের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে।
এ ছাড়া উৎপাদন পর্যায় থেকে ভোক্তার পানের আগ পর্যন্ত পাস্তুরিত তরল দুধ নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় শীতলীকরণব্যবস্থা বা কুল চেইন রক্ষা করে বাজারজাত ও সংরক্ষণ করতে হয়। এই সীমাবদ্ধতার কারণে পাস্তুরিত দুধ পুরো দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া কঠিন।
সব মিলিয়ে ইউএইচটি পদ্ধতির বাড়তি সুবিধা হলো, যেখানে পাস্তুরিত দুধ খাওয়ার উপযোগী থাকে ৭ থেকে ১০ দিন, সেখানে ইউএইচটি দুধ রেফ্রিজারেটরে রাখা ছাড়াই ছয় মাস খাওয়ার উপযোগী থাকে। এ দুধ ফোটাতে হয় না। ফলে তা পানে ঝক্কি কম। ইউএইচটি পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাত করলে দুধে পুষ্টি উপাদান নষ্ট হয় না। আবার বাজারজাতকালে গুণগতমান নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিও কম। এ জন্য বিপণন সহজ হয়।
আজ সোমবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব দুগ্ধ দিবস। দুগ্ধ খাত–সম্পর্কিত কার্যক্রমে নজর বাড়াতে ২০০১ সাল থেকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) উদ্যোগে দিবসটি পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশে কীভাবে দুধ মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছানো যায়, তা এ দিবস উপলক্ষে আলোচনায় আসছে।
ইউএইচটি দুধের বাজারে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘বিশ্বের উন্নত দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের দুগ্ধশিল্প বাঁচাতে আমাদেরও উন্নত প্রযুক্তির সুবিধা নিতে হবে। খামারিদের অতি কষ্টে উৎপাদিত দুধ ইউএচটি প্রযুক্তির মাধ্যমে সারা দেশের ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিতে পারলে একদিকে যেমন তাদের পুষ্টি চাহিদা মিটবে, তেমনি দুগ্ধ খামারিরাও উপকৃত হবেন।’
কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘প্রাণ ডেইরি এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আস্থার সঙ্গে ইউএইচটি দুধ উৎপাদন ও সরবরাহ করে আসছে। উৎপাদন কেন্দ্র (ডেইরি হাব) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে খামারিদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে মানসম্মত দুধ সংগ্রহ করে সম্পূর্ণ হাতের স্পর্শ ছাড়াই প্রাণ ইউএইচটি দুধ প্রক্রিয়া ও বাজারজাত করছে, যা অত্যন্ত স্বাস্থ্যসম্মত।’
দুধ পান সামান্য
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পরামর্শ হলো, একজন মানুষের দৈনিক গড়ে ২৫০ মিলিলিটার দুধ পান করা দরকার। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে পরিমাণটি তিন ভাগের এক ভাগ। যদিও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে তা ১৬৫ মিলিলিটার।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে দুধ উৎপাদন হয়েছিল ৯৯ লাখ মেট্রিক টন, যা মোট চাহিদার ৬৫ শতাংশের মতো।
ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে, দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিগুলো দেশের মোট উৎপাদিত দুধের মাত্র ৫ শতাংশ প্রতিদিন সংগ্রহ করে। এর পরিমাণ সাড়ে ১৩ লাখ লিটারের মতো।
কোম্পানিগুলোর মতে, আগামী দিনগুলোতে শহরায়ণ ও মানুষের জীবনে ব্যস্ততা বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রক্রিয়াজাত দুধের চাহিদা বাড়বে।
বাজার বড় হচ্ছে
দেশের বাজারে পাস্তুরিত তরল দুধ, ইউএইচটি তরল দুধ ও গুঁড়া দুধ বাজারজাত করে কোম্পানিগুলো। মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনে (বিএসটিআই) নিবন্ধিত ১৪টি দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে প্রাণ ডেইরি, ব্র্যাক ডেইরি ও আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ইউএইচটি প্ল্যান্ট রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রাণ ডেইরির হিস্যা ৮০ শতাংশের মতো। প্রাণ জানিয়েছে, তারা যে পরিমাণ তরল দুধ বাজারজাত করে, তার ৬৫ শতাংশের মতো ইউএইচটি। বছরে ইউএইচটি দুধের বাজার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে।
দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়নেরও (মিল্কভিটা) ইউএইচটি প্ল্যান্ট ছিল। তবে সেটা বন্ধ। মিল্কভিটার ব্যবস্থাপনা পরিচালক অমর চান বণিক প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা আবার নতুন করে ইউএইচটির বাজারে আসার পরিকল্পনা করছেন।
সংরক্ষণ সহজ
দেশে করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাব ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে দেওয়া সাধারণ ছুটির শুরুর দিকে দুধের চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে যায়। তখন খামারিরা বিক্রি করতে না পেরে দুধ ফেলে দেন, যা বাংলাদেশের মতো দুগ্ধ ঘাটতিতে থাকা দেশের জন্য অপ্রত্যাশিত। অথচ ইউএইচটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই দুধ সহজেই ভোক্তা সাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।
ব্র্যাক ডেইরির পরিচালক মোহাম্মদ আনিসুর রহমান বলেন, ‘সাধারণ ছুটির শুরুর দিকে যখন খামারিরা দুধ ফেলে দিচ্ছিলেন, তখন আমরা তালিকাভুক্ত খামারিদের বাইরেও দৈনিক ৪০ হাজার লিটার বাড়তি দুধ সংগ্রহ করেছি। সেটার একটা অংশ ইউএইচটি করা হয়েছে।’
দুধ বিপণনের ক্ষেত্রে ইউএইচটি পদ্ধতি অধিকতর স্বাস্থ্যসম্মত ও ঝক্কিহীন বলে উল্লেখ করেন আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, অনেক সময় দেখা যায় দোকানদারেরা রাতে রেফ্রিজারেটর বন্ধ করে বাসায় চলে যান। এ ধরনের ঘটনায় পাস্তুরিত দুধের মান ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ইউএইচটিতে সেই সমস্যা নেই। তিনি আরও বলেন, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া ও সুইজারল্যান্ডের মতো দেশে এবং যুক্তরাষ্ট্রের শহর এলাকায় সিংহভাগ মানুষ ইউএইচটি দুধ পান করে।
তরল দুধ গুঁড়ায় পরিণত করেও সংরক্ষণ করা যায়। তবে দেশীয় তরল দুধ দিয়ে এক কেজি গুঁড়া দুধ উৎপাদনে খরচ প্রায় ৪২০ টাকা। বিপরীতে আমদানি করা যায় ৩৩০ টাকার মধ্যে। ফলে দেশে গুঁড়া দুধ উৎপাদন লাভজনক নয়।
ইউএইচটি দুধের একজন নিয়মিত গ্রাহক বেসরকারি চাকরিজীবী নিয়াজ মোর্শেদ। কয়েক বছর ইউরোপে বাস করার অভিজ্ঞতায় তিনি বলেন, ‘উন্নত দেশে ইউএইচটি দুধ বেশি বিক্রি হয়। দেশেও এখন পাচ্ছি। নইলে ফোটানোর ঝামেলার কারণে দুধ পান করাই হয়তো হতো না।’