এ শহর কি তবে আমার নয়
>পড়াশোনা, চাকরি কিংবা কাজের কারণে ঢাকা শহরে একা চলাফেরা করতে হয় অনেক নারীকেই। কোটি মানুষের শহরে নারীরা যেন তারপরও একা। নানা ধরনের বাধা আর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়িয়ে তাঁদের চলতে হয়। এই কি তবে আধুনিক শহরের নমুনা! যেখানে নারী নিরাপদ বোধ করেন না। এই নিয়ে প্রতিবেদন।
বিস্মিত হতেও যেন ভুলে গেছি আমরা। একের পর এক ঘটনা ঘটে যা কষ্ট দেয়, ক্ষোভ জন্ম দেয় মনে। সময়ের স্রোতে একসময় হয়তো তা সয়ে যায়, তবে মনের গহিনে তৈরি হওয়া তীব্র ভয়টা কি মুছে যায়? এই শহর, এই প্রাণের শহরে চলার পথে প্রাণ কেঁপে কেঁপে ওঠে আমাদের।
৫ জানুয়ারি সন্ধ্যা ছয়টার দিকে রাজধানীর কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হন। কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ড থেকে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন তিনি। গলফ ক্লাবসংলগ্ন স্থানে পৌঁছানোর পর এক ব্যক্তি তাঁকে পেছন থেকে গলা ধরে মাটিতে ফেলে দেন। তাঁর গলা চেপে ধরে মারধর করেন। ছাত্রী অজ্ঞান হয়ে গেলে তাঁকে ধর্ষণ করেন। এ ঘটনায় পরে মজনু নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। র্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ২৮ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি একজন ‘সিরিয়াল রেপিস্ট’ বা ‘ক্রমিক ধর্ষক’। ভিক্ষুক বা প্রতিবন্ধী নারীরা ছিলেন হকার মজনুর মূল শিকার।
নিশ্চিত করেই বলা যায়, প্রতিটি নারীরই বুক কেঁপেছে এ ঘটনায়। পরিকল্পিত অপরাধ নয়, ঘটনার ধরনে বলা যায়, ওই সময় ঘটনাস্থলে যে–ই থাকত, সে-ই এই ভয়ংকর ঘটনার শিকার হতো। তবে এটা ভাবার কোনো অবকাশ নেই যে এটি ব্যতিক্রমী কোনো ঘটনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রী নিজের ওপর ঘটা অন্যায়ের কথা বন্ধু ও শিক্ষকদের বলেছেন বলে ঘটনাটি আমাদের সামনে এসেছে। এর প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে তাৎক্ষণিকভাবে অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে সব সময় এমনটা হয় না। সমাজ ও তথাকথিত লজ্জার তীব্র ভয় এবং আতঙ্ক নিয়ে চুপ হয়ে যান আক্রান্ত নারী।
নিরাপত্তা যেন কোথাও নেই
কখন নিরাপদ? কোথায় নিরাপদ? এসব প্রশ্নের যেন উত্তর নেই। একা একা বেড়াতে যাওয়া যাবে না, সন্ধ্যার পর বাইরে থাকা যাবে না, কৈশোরে পা দিতে না–দিতেই বাইরে খেলতে যাওয়া নিষেধ, ছাদে যেয়ো না, রাস্তার পাশের জানালা বন্ধ রাখো, পোশাক–পরিচ্ছদে বিধিনিষেধ—সবকিছুতেই যেন বুঝিয়ে দেওয়া হয়, নারী, তুমি নিরাপদ নও। এত ভয় ঢুকিয়েও কি বাঁচানো যায়?
গত বছরের ৫ জুলাই রাজধানীর ওয়ারীতে সাত বছরের শিশু সামিয়া আক্তারকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। সামিয়া ভবনের একটি ফ্ল্যাটে খেলতে গিয়েছিল। পরে তাঁর লাশ পাওয়া যায় ওই ভবনেরই একটি নির্মাণাধীন ফ্ল্যাটে।
কতগুলো ঘটনার কথা বলব? প্রাণের এ শহরকে ঘিরে থাকা ভয়ংকর মানুষেরা ছিনিয়ে নেন মেয়েদের শৈশব, কাঁটা বিছিয়ে দেন তাঁদের স্বাভাবিক চলার পথে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সোমা জানান, প্রতিদিন অফিস শেষে রাতে মতিঝিল থেকে বাসে করে মিরপুরে যান। মিরপুর ১১ নম্বরে আসার পর প্রায়ই বাসে আর কোনো যাত্রী থাকে না। সোমা বলেন, ‘এত ভয় লাগে। পুরো সময় দোয়া পড়তে থাকি। মাঝেমধ্যে বাবা বা কোনো বন্ধুকে ফোন দিয়ে কথা বলি। এত আতঙ্ক হয়!’ আতঙ্কের তো কারণ আছেই। রাজধানীতে চলন্ত বাসে ধর্ষণের মতো ঘটনাও এখন আর আমাদের অবাক করে না।
কেউই কি নিজেকে পুরোপুরি নিরাপদ মনে করেন
বড় পদে কর্মরত হন বা বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, শ্রমিক হন বা গৃহিণী—কেউ কি পুরোপুরি নিরাপদ বোধ করেন? সেদিন কালশীতে রিকশা খুঁজতে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক নারী। রাত নয়টা বাজে তখন। হঠাৎ করেই মোটরসাইকেল করে যাওয়া দুই যুবক ওই নারীকে অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ করে। তিনি পড়ে যান। হাতটা বাজেভাবে কেটে যায়। পরে আশপাশের কয়েকজনের সহায়তায় বাড়ি ফেরেন তিনি। একবার ঘটে যাওয়া এ ধরনের ঘটনা কি তাঁর স্বাভাবিক চলাফেরায় বাধা দেবে না?
সম্প্রতি এক নারী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ঘটনা প্রকাশ করেন। তিনি জানান, একদিন রাতে নিজের বাসা থেকে বাবার বাসায় যাওয়ার জন্য বের হয়েছেন। রিকশা নিয়ে সিএনজি চালিত অটোরিকশার স্টেশনে গিয়ে দেখেন কিছু নেই। আরেকটু এগিয়ে একটা জায়গায় দাঁড়ান পরিবহনের জন্য। একটু দূরে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ চলছে। কর্মীরা একটা ছাউনির নিচে বিশ্রাম নিচ্ছেন। মিনিট তিনেকের মাথায় একটা গাড়ি এল। পার হয়ে চলে গিয়েছিল, হঠাৎ আবার পিছিয়ে এল। জানালার কাচ নামিয়ে কুৎসিত কথা বললেন গাড়ির ভেতরে থাকা এক লোক। একা দাঁড়িয়ে থাকা ওই নারী সঙ্গে সঙ্গে বিপদ আঁচ করতে পারলেন। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় নড়তে পারছিলেন না তিনি। এর মধ্যে লোকটা নামলেন এবং ওই নারীকে গাড়িতে উঠতে বললেন। এমনকি তাঁর হাত ধরেও টান দিলেন। ধাক্কাধাক্কিতে তাঁর ব্যাগটা নিচে পড়ে যায়, ফলে সাহায্যের জন্য কাউকে ফোনও দিতে পারেন না। শেষে ‘বাবা আমাকে বাঁচাও বলে’ চিৎকার দেন এবং সব শক্তি দিয়ে লোকটাকে সরানোর চেষ্টা করেন। তাঁর চিৎকারে দুজন এগিয়ে আসেন। তাঁদের হাতে বড় টর্চ ছিল। একজন ওই নারীকে সরিয়ে নেন। আরেকজন টর্চ দিয়ে লোকটাকে মারধর করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে ওই লোক পালিয়ে যান। ওই নারী জানান, এই ঘটনার পর কয়েক রাত ঘুমাতে পারেননি। ভয়ংকর সব স্বপ্ন দেখে উঠে পড়েছেন। মনোরোগ চিকিৎসকের শরণাপন্নও হন তিনি।
এসব ঘটনা একজন মেয়ের জীবনে কেমন প্রভাব ফেলে, তা আর বলার মতো নয়। আর যাঁরা এসব ঘটনার মুখোমুখি হন না, তাঁরাও শুনে ট্রমাটাইজড হয়ে স্বাভাবিক চলাফেরার গতি হারিয়ে ফেলেন। আতঙ্কিত হয়ে দেশ ছাড়ার কথাও ভাবেন কেউ কেউ। অনেকে হয়তো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে নিজস্ব কিছু ব্যবস্থা নেন, আত্মরক্ষার কসরত শেখেন। তারপরও কতটুকু নিরাপদ বোধ করেন?
ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত ও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজিএম) আদালতের সাধারণ নিবন্ধন খাতা অনুযায়ী, গত বছর ধর্ষণ ও গণধর্ষণসংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগে ঢাকায় মামলা হয়েছে মোট ৫৪৫টি। এগুলোর তো মামলা হয়েছে, কিন্তু এমন অনেক ঘটনা আছে যা সামনেই আসেনি। নারীর জন্য আতঙ্কের এক নগরীতে পরিণত হচ্ছে ঢাকা।
ভুক্তভোগীরই দোষ খোঁজা হয়
যদি নারীর জীবনে কিছু ঘটেই যায়, তবে কিসের দোষ, তা নিয়ে উঠেপড়ে লাগে সমাজ। প্রথমেই জেনে নেওয়া হয়, মেয়েটি কী পোশাক পরে ছিল, কোথায় যাচ্ছিল, সঙ্গে কোনো ছেলে বন্ধু ছিল কি না, এত রাতে কেন বের হয়েছিল, মেয়েটির কোনো পছন্দের মানুষ আছে কি না ইত্যাদি। এসবের কোনোটাকে যদি ঘটনার জন্য কারণ হিসেবে বসানো না যায়, তাহলে সরাসরি বলে দেওয়া হয়, একা একা বের হওয়ার কী দরকার ছিল?
আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-সংসারে পান থেকে চুন খসলেই নারীর দোষ। মেয়েটির দোষ খুঁজে বের করতে গিয়ে আসল সমস্যার ধারকাছ দিয়েও যায় না সমাজ। অনেক পরিবারেই সন্তানের সামনেই বাবা মাকে প্রহার করেন। নারীর চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়—এমন বোধ মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ‘নারীর বুদ্ধি-শুদ্ধি কম’, ‘বাইরে যেতে বাসার পুরুষ মানুষের অনুমতি লাগবে’, ‘স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত’, ‘মেয়ে মাতব্বরে সংসার চলে না’, ‘ছেলেসন্তান না হলে দায় স্ত্রীর’, ‘অভাগার গরু মরে ভাগ্যবানের বউ মরে’—এমন সব প্রবাদে ছোটবেলা থেকেই ছোট্ট শিশুর মনে তৈরি হয় যে পুরুষের জন্যই নারী।
আমাদের পরিবারের মেয়েশিশুকে কার্টুন মিনার মতো বারবার প্রমাণ করতে হয়, তারও সবকিছুতে সমান অধিকার আছে। এই ধরনের পারিবারিক ধারণা নিয়ে ধীরে ধীরে যে ছেলেটি শিশু-কিশোরের বয়স পেরিয়ে যুবক হন, তাঁর মধ্যে নারীর প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধাবোধ সেভাবে কাজ করে না। সেই সঙ্গে ছোটবেলা থেকে নারীর পোশাকের দোষ দিতে দিতে ছেলেগুলোর মধ্যে কখন যে ধর্ষকামী মানসিকতা তৈরি করা হয়, তা এই সমাজ নিজেও জানে না। যাই হোক না কেন, ভুক্তভোগী মেয়েটিকেই দোষারোপ করা হয়।
গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ
এমন সামাজিকীকরণে এগুলোকে আর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বলা যায় না। এটি একটি ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের বহিঃপ্রকাশ। এর প্রতিরোধ গড়ে তুলতেই হবে। যে মেয়ে নির্যাতনের শিকার, তার কী হবে—এমন হাহাকার না করে, সমাজকে আঙুল তুলতে হবে সেই ছেলের দিকে, যে ধর্ষক। তার অপরাধকে ঘৃণা করতে শেখাতে হবে। এতে নারীর কোনো দায় নেই, থাকতে পারে না। এটাকে সামাজিকভাবেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবা নাসরীন বলেন, ‘একেকটা ঘটনা সামনে আসে আর আমাদের চেতনা জেগে ওঠে। অথচ এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। প্রতিটি ঘটনায় সামনে আসে নিরাপত্তাহীনতার বিষয়।’
আমাদের নারীদের চলতে হয়। তবে এসব ঘটনা নারীকে চলার পথে আতঙ্কিত করে তোলে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করার পাশাপাশি সামাজিকভাবেও সোচ্চার হতে হবে। বাংলাদেশে সামাজিকীকরণ ভিন্নভাবে হয়। ‘মেয়েরা এভাবে বসে না’, ‘মেয়েরা জোরে কথা বলে না’, ‘ছেলেরা মেয়েদের মতো কাঁদে না’, ‘ছেলেদের লজ্জা পেতে নেই’—এসব ধারণা ছোটবেলা থেকেই মাথার ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি ২০১৩ সালের আগে পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকেও এসবের পরিবর্তনের কথা ভাবা হয়নি। তবে এখন বিষয়টি পাল্টানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, যা খুবই জরুরি।
মাহবুবা নাসরীনের মতে, এই শহরকে নিরাপদ করতে শিকড় থেকেই পরিচর্যা করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে কেউই নিরাপদ নয়। নারী, শিশু, ছেলেশিশু কেউ নয়। রাজধানীর যেসব স্থানে নিরাপত্তাজনিত ঘাটতি আছে বলে মনে করা হয়, সেসব জায়গায় নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। এভাবে কিছুটা হলেও নিরাপত্তাবোধ আনা যাবে।