রান্না একটি শিল্প। শিল্পী যেমন যত্ন নিয়ে তাঁর তুলির ছোঁয়ায় একটি ছবিকে মনের মতো করে ফুটিয়ে তোলেন, তেমনি মনোযোগ দিয়ে রান্না করলে যে কারও মুখে খাবারের স্বাদ দীর্ঘদিন পর্যন্ত থেকে যায়। রান্না আর রন্ধনশৈলী দুটো দুই জিনিস। রান্না করা হয় শুধু খাওয়ার উদ্দেশে। রন্ধনশৈলী ব্যাপারটা হচ্ছে রান্নার স্বাদ থেকে শুরু করে পরিবেশন পর্যন্ত।
একটি সময় ছিল যখন রান্নাবান্না ছিল শুধু ঘরকেন্দ্রিক। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে এখন রন্ধনশিল্প সেক্টর অনেক শক্ত একটা জায়গায় অবস্থান করছে। এই ঘরের মানুষ যখন তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নিতে চাচ্ছেন, তখনই এগিয়ে আসছে রিয়েলিটি শোগুলো। সবচেয়ে বেশি উপকৃত হচ্ছেন তাঁরা, যাঁরা নিজেদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে চাচ্ছেন। এর কারণ, এর মাধ্যমে অনেকেই পেশা গড়তে পারছেন। তাঁদের জন্য এগিয়ে আসা ব্র্যান্ডগুলোর মাধ্যমে রিয়েলিটি শোর মতো একটা প্ল্যাটফর্মে প্রতিযোগীরা যোগাযোগ তৈরি করেন। সেখান থেকে রন্ধনশিল্পের পেশায় পথচলা শুরুর সুযোগ পান।
এসব রিয়েলিটি শো সাধারণত প্রতিযোগীদের জীবনে কেমন প্রভাব ফেলে, সেই সম্পর্কে বিভিন্ন শেফ এবং বিচারকের মতামত জানতে চাওয়া হলে বিভিন্ন মন্তব্য পাওয়া যায়।
রন্ধনশিল্পী ও বিচারক কল্পনা রহমান মনে করেন, ‘সাত বছর বয়সে যখন আমার মা মারা যান, তখন আমার ছোট আরও দুই ভাইবোন ছিল। রেঁধেছি প্রয়োজনে। এভাবে কখন যেন রান্নাটাকে ভালোবেসে ফেলেছি। পদে পদে সম্মুখীন হয়েছি নানা বাধার। এটা ছিল আশির দশকের কথা। তখন এখনকার মতো এত টিভি চ্যানেল ছিল না, ছিল না কোনো রিয়েলিটি শো। এখন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রন্ধনশিল্পের জায়গাটি অনেক এগিয়ে গেছে। তৈরি হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান। আগে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ কাজ করত, এখন এই কাজে উচ্চ শিক্ষিত মানুষও আগ্রহী হচ্ছে।’
মাস্টারশেফ ড্যানিয়েন সি গোমেজের মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে এখন রান্নার ওপর রিয়েলিটি শো হচ্ছে। এটা একটি বড় জায়গা শেফ তৈরি করার জন্য। রিয়েলিটি শোতে যেসব প্রতিযোগী নিজের একটি ছোটখাটো অবস্থান তৈরি করতে পেরেছেন, তাঁরাও এই রন্ধনজগতে নিজের একটা বড় প্রভাব ফেলতে পেরেছেন। রিয়েলিটি শোর বিচারকদের পেশাদারত্ব ও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের সংমিশ্রণে একজন স্বপ্নচারী তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে পারছেন।
এই প্রসঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল কারিনারি ইনস্টিটিউটের ট্রেনিং ডিরেক্টর জাহঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমার মতে, বাংলাদেশের বর্তমান রিয়েলিটি শোগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশের রন্ধনশিল্প এখন বিশ্বের দরবারে আরও জোরদার পরিচিতি পাওয়া শুরু করেছে। এই ক্ষেত্রে স্পনসরদের কথা না বললেই নয়, রিয়েলিটি শোগুলোর পেছনে তাদের একটা সমর্থন রয়েছে। সাম্প্রতিক বিশ্বের বৈশ্বিক যোগাযোগ উন্নত হওয়ার কারণে যে কেউ রিয়েলিটি শো, ভিডিও দেখে উৎসাহ পাচ্ছেন নতুন কিছু তৈরি করার।’
রুপচাঁদা সুপার শেফ ২০১৯–এর প্রথম রানার আপ কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘আগে কাজ করতাম, কিন্তু আমার তেমন পরিচিতি ছিল না। এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের ফলে এখন আমাকে অনেকেই চেনেন।’
রুপচাঁদা সুপারশেফ ২০১৮–এর চতুর্থ স্থান অধিকারী মইনুল হক বলেন, রিয়েলিটি শোতে অংশগ্রহণ করা একটি অনেক বড় ব্যাপার, পরিচিতি লাভ করা যায়। রুপচাঁদা সুপার শেফের চ্যাম্পিয়ন রাফিয়া আহমেদের জীবন বদলে দেওয়ার মতো একটি অধ্যায় ছিল ‘রুপচাঁদা–দ্য ডেইলি স্টার সুপার শেফ ২০১৬’। এখন তিনি একজন প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন একটি প্রতিষ্ঠানে। রুপচাঁদা সুপার শেফ ২০১৫–এর প্রথম রানারআপ জেবুন্নেসা জেবা বলেন, নিজেকে আবিষ্কার করার একটা বড় মাধ্যম ছিল সুপার শেফে অংশগ্রহণ করা। বর্তমানে তিনি দেশে এবং দেশের বাইরে কাজ করছেন, রেসিপি লিখছেন। রুপচাঁদা সুপার শেফ ২০১৪–এর দ্বিতীয় রানার-আপ নাসরিন হোসেন বলেন, ‘এই শোতে অংশগ্রহণ করার ফলে আমরা যাঁরা বাইরে বের হয়ে কাজ করার সুযোগ পাই না, ঘরে বসে রান্না করে আয়ের একটা উৎস পাচ্ছি এবং স্বাবলম্বী হতে পারছি।’
বর্তমানে রিয়েলিটি শোগুলো অনেক স্বপ্নবাজদের প্রতিভা বিকাশে এগিয়ে আসছে, প্রতিভার অন্বেষণে তাদের নিজ নিজ আগ্রহে পৌঁছে যাচ্ছে গ্রামেগঞ্জে। বাংলাদেশের আজকের প্রজন্ম পেশা গড়ছে শেফ হিসেবে, যা তাদের মনকে দিচ্ছে পরিপূর্ণতা। আশা করা যায়, বাংলাদেশের স্বনামধন্য ব্র্যান্ডগুলোর সহায়তায় এবং বিচারকদের সূক্ষ্ম বিচারকার্যে রিয়েলিটি শোগুলো ভবিষ্যৎ কর্ণধারদের যোগ্য শেফ হিসেবে তৈরি করতে বড় ভূমিকা পালন করবে।