জীবনযাপনে প্রকৃতির নির্যাস
>
সৌন্দর্যচর্চা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস কিংবা ফিটনেস—ভরসা যেন প্রকৃতিই। প্রাকৃতিক সব উপাদানই আয়ুর্বেদের মূল বিষয়, যাতে কোনো রাসায়নিক নেই। তাই জীবনযাপনের ক্ষেত্রে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে আয়ুর্বেদিক রূপচর্চা কিংবা খাদ্যাভ্যাস।
রূপচর্চায় আয়ুর্বেদ শব্দটির জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলছে। কারণ রূপচর্চার প্রাচীন এই পদ্ধতিতে নেই কোনো রাসায়নিক উপকরণের ব্যবহার। প্রকৃতির চারপাশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা ভেষজ উপাদান এই রূপচর্চার মূল উপকরণ। যে কারণে মানুষের আস্থা বাড়ছে আয়ুর্বেদের ওপর। এখন শুধু রূপচর্চায় নয়, খাদ্যাভ্যাসসহ জীবনযাপনের নানা ক্ষেত্রেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে আয়ুর্বেদ।
আয়ু মানে জীবন আর বেদ হলো জ্ঞান। সুস্থ–সুন্দর দীর্ঘ জীবনযাপনের বিজ্ঞান হলো আয়ুর্বেদ—এমনটাই বলেন হারমনি স্পার আয়ুর্বেদিক রূপবিশেষজ্ঞ রাহিমা সুলতানা। প্রায় ৫০০০ বছর আগে প্রাচীন ভারতে এই আয়ুর্বেদশাস্ত্রের উৎপত্তি। শারীরিক, মানসিক আর আত্মিক সুস্থতার মেলবন্ধন ঘটে এই আয়ুর্বেদে। এই পদ্ধতিতে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের প্রতি নজর দেওয়া হয় বেশি। নিয়ম মেনে প্রতিদিনকার জীবনযাপনে পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস, শরীরচর্চা আর প্রাকৃতিক জিনিসের ব্যবহার শেখায় আয়ুর্বেদ।
নিজের কাছে নিজেকে উপস্থাপন
নিজেকে শুভ সকাল জানিয়ে শুরু হোক প্রতিটি সকাল। রাহিমা সুলতানা বলছিলেন, নিজের ভালো থাকার বিষয়টিকে আয়ুর্বেদে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়। কারণ আপনি নিজে যখন সুস্থ–সুন্দর থাকবেন, তখনই খেয়াল রাখতে পারবেন অপরের প্রতি। এভাবে সকালে ঘুম থেকে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ইতিবাচক কিছু কথা বলে নিজের দিনটি শুরু করুন।
স্বাস্থ্যকর পানীয়
সকালে এক গ্লাস দুধের সঙ্গে এক চা–চামচ কাঁচা হলুদবাটা মিশিয়ে নিন। এই পানীয় খালি পেটে পান করুন। একইভাবে এক গ্লাস কুসুম গরম পানিতে লেবু ও মধু মিশিয়ে নিতে পারেন। আয়ুর্বেদশাস্ত্রমতে, দুধ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ খাবার, যা আপনার সারা দিনের ক্লান্তি দূর করবে। পাশাপাশি শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টির ঘাটতি মেটাবে। অপর দিকে দুধের সঙ্গে হলুদ মিশিয়ে খেলে তা শরীরের টক্সিন বের করতে সাহায্য করে, যা ধরে রাখবে ত্বকের বাহ্যিক সৌন্দর্য। একইভাবে লেবু ও মধুমিশ্রিত পানি শরীরের ভেতরকার বাড়তি মেদ ঝরিয়ে উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
প্রাণায়াম
সকালের বাতাসে ১০ মিনিটের প্রাণায়াম সারা দিনের জন্য আনবে স্বস্তির আশ্বাস। কপাল ভাতি, ভ্রামরী, ডিপ ব্রিদিংয়ের মতো প্রাণায়ামগুলো নিশ্বাসের মাধ্যমে শরীরের ভেতরকার বিষ বা টক্সিন বের করে অক্সিজেন সরবরাহ করতে সাহায্য করে। এ ছাড়া প্রাণায়ামের মাধ্যমে মনের অস্থিরতা দূর হয়। আয়ুর্বেদশাস্ত্রানুযায়ী নিয়মিত প্রাণায়ামের অভ্যাস যেকোনো কাজের প্রতি মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে।
যোগাসন
প্রাণায়ামের পরের ১৫ মিনিট যোগাসন করা ভালো। নিয়মিত যোগাসনচর্চায় নানা ধরনের রোগমুক্তি ঘটে। সূর্য নমস্কার সবচেয়ে উপকারী আসন। তবে প্রথম দিকে সূর্য নমস্কারের চর্চা না করে হালকা যোগব্যায়াম দিয়েই এর চর্চা করা উচিত।
রূপচর্চায় প্রাকৃতিক উপাদান
বরাবরই আয়ুর্বেদীয় পদ্ধতিতে রূপচর্চায় প্রাকৃতিক জিনিসের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হয়। বেসন, ডালের গুঁড়া, চালের গুঁড়া, নানা রকম ভেষজ তেল, বাদাম, আমলকী, মেহেদি ও জবা ফুলের মতো প্রাকৃতিক উপাদানগুলো আয়ুর্বেদিক রূপচর্চায় মূল উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রাসায়নিক উপকরণ ব্যবহারে যেমন খুব দ্রুতই ফল পাওয়া যায়, আয়ুর্বেদিক রূপচর্চায় এর উল্টোটা ঘটে। অর্থাৎ আয়ুর্বেদীয় পদ্ধতিতে ফলটা আসে অনেক ধীরে। তবে এর দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল অনেক সুদূরপ্রসারী, যার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
নিয়মিত হাঁটা বা একটু দৌড়ানো
সময় পেলে একটু দৌড়ানো বা জগিংয়ের অভ্যাস অনেকেরই আছে। জানেন কি এই পদ্ধতিটিও আয়ুর্বেদিক জীবনযাপনের একটি অংশ। প্রতিদিন আধঘণ্টা হাঁটা বা দৌড়ানোর ফলে শরীরের বাড়তি মেদ ঝরে বাড়ে কর্মস্পৃহা। যা শরীরের অনেক রোগকে দূরে রাখতে সাহায্য করে।
হালকা খাবার
আয়ুর্বেদশাস্ত্রে দুধজাতীয় খাবার দিয়ে দিনটা শুরু করার কথা জানালেন রাহিমা সুলতানা। প্রাচীন ভারতে যাঁরা আয়ুর্বেদচর্চা করতেন, তাঁদের সকালের খাবারের তালিকায় থাকত সবজি–খিচুড়ি। খিচুড়িতে চাল, ডাল ও সবজি থাকায় প্রায় সাধারণের পুষ্টির চাহিদা পূরণ হতো। সবজি–খিচুড়ি খেতে না চাইলে এর পরিবর্তে দুটি রুটি আর এক বাটি সবজি দিয়েও সকালের খাবার শুরু করতে পারেন। মাঝখানে একটি ফল খেতে পারেন। দুপুরের খাবারে থাকতে পারে মাছের ঝোল, আঁশজাতীয় খাবার, এক বাটি ভাত আর ডাল। বিকেল বা সন্ধ্যায় থাকল এক বাটি মুড়ি বা চিড়ে ভাজা। রাতের খাবারটাও দুপুরের মতো হবে। ঘুমানোর আগে এক কাপ গরম দুধ বা টক দই খেতে পারেন, যা পরবর্তী দিনের জন্য আপনাকে শক্তি জোগাতে সাহায্য করবে।
ঘুমানোর আগে
আত্মার শুদ্ধতা নিয়ে ঘুমাতে যাওয়ার কথা বলা আছে আয়ুর্বেদশাস্ত্রে। অর্থাৎ সারা দিনের সব দুশ্চিন্তা, ক্লান্তি ভুলে ঘুমাতে যেতে হবে। রাতে শরীরের ভেতরে চলে পুনর্নির্মাণের কাজ। আয়ুর্বেদশাস্ত্রে তাই ঘুমাতে যাওয়ার আগে স্নানের কথা বলা আছে। স্নানের কারণে ত্বকের লোমকূপ পরিষ্কার হয়। আর জলের ধারা সারা দিনের ক্লান্তি দূর করতে সাহায্য করে। ঘুমানোর ঘরে হালকা আলো আর ফুলের সুগন্ধি ব্যবহারের উল্লেখ আছে আয়ুর্বেদে।
ঘরোয়া টোটকা
রোগ সারাতে নানা ধরনের ঘরোয়া টোটকার প্রচলন রয়েছে আয়ুর্বেদে। এই যেমন আমলকী সেদ্ধ করে এর বিচি বের করে নিন। এবার সেদ্ধ আমলকী মধু মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে সংরক্ষণ করুন। সকালে নিয়মিত এটি খেলে দূর হবে ঠান্ডা কাশির সমস্যা। যাঁদের গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে, তাঁরা আগের দিন রাতে ত্রিফলা (আমলকী, হরীতকী, বহেড়া) পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। পরদিন সকালে খালি পেটে এই পানি পান করুন। এতে পেটের সব সমস্যা দূর হবে।
আয়ুর্বেদীয় সেবা
শুধু আয়ুর্বেদিক সেবা দিতেই গড়ে উঠেছে নানা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রোগ নির্ণয় করে দেওয়া হয় নানা ধরনের সেবা। এই যেমন শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি দূর করতে আছে শিরোধারা। শরীরের ব্যথা নিরাময়ে আছে পদিখিজি, ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াবে নভোরাক্ষিজি। রুক্ষানাম দূর করবে ত্বকের দাগ। এমনই আরও নানা সেবা পাবেন এসব প্রতিষ্ঠানে।