বেলা শেষে প্রেম
রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৬৩ বছর। সেই যুগে বাঙালির গড় আয়ুর হিসাবে এই বয়সের একজন মানুষকে বৃদ্ধ বলা যেতেই পারে। সেই বয়সে তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠল এক বিদেশি নারীর। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো নামে আর্জেন্টাইন সেই নারীর বয়স তখন ৩৪। অনেকেই এই সম্পর্কের নাম দিয়েছেন প্রেম। অনেকে বলেছেন, নিষ্কাম ভালোবাসা। কিন্তু ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথকে কীভাবে দেখেছেন, রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য তাঁকে কতটা আকর্ষণ করেছে, সেটা প্রকাশিত হয়েছে তাঁরই লেখায়, ‘আমার বাবার বয়সের কাছাকাছি তাঁর বয়স। অথচ কপালে ভাঁজ পড়েনি। একটিও রেখা চোখে পড়ে না। কী শান্ত লাবণ্যময় তাঁর হিরণবর্ণ দেহ। শুভ্র কেশগুচ্ছ উপচে পড়ছে তাঁর দৃঢ় সুগঠিত গ্রীবা পর্যন্ত। তাঁর দীপ্ত মুখমণ্ডল, ঘন আঁখিপল্লব, তাঁর বাঙ্ময় দুটি হাত—মানুষটির সান্নিধ্যে আসায় সমস্ত শরীর অবশ হয়ে এল।’ আদরের উপবাস বইয়ে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় এভাবে প্রায় উপন্যাসোপম করে তুলেছেন দুজনের সম্পর্ককে।
নারীর সঙ্গে সম্পর্ক রবীন্দ্রনাথকে যেন নতুন জীবন দিল। কিছুদিন আগে তিনি লিখেছিলেন, ‘প্রাণকে বহন করার যোগ্য শক্তি আমার শেষ হয়ে গেছে।’ অথচ ১৯২৪ সালে ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে পরিচয় ও সান্নিধ্য তাঁর মনকে সজীব করে তুলল। ‘ভিক্টোরিয়া’ শব্দ অনুবাদ করে বিদেশিনীর নতুন নাম দিলেন ‘বিজয়া’।
ওকাম্পো তখন একজন সম্পূর্ণ নারী। রবীন্দ্রনাথ পার হয়েছেন প্রৌঢ়ত্বের সীমানা। ভিক্টোরিয়ার সঙ্গ ও সান্নিধ্য পেলে আনন্দিত হন তিনি। কিন্তু একটি সীমানার বেশি কি তা যাওয়া সম্ভব?
১৯২৫ সালের জানুয়ারি মাসে আর্জেন্টিনা থেকে ফিরে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু তাঁর জীবন ও স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাননি ভিক্টোরিয়া। তাঁর ‘বিজয়া’কে তিনি গানে-কবিতায় মূর্ত করে তুলেছিলেন বর্ণে-গন্ধে-ছন্দে। রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির যে এক অনন্য সৌন্দর্য আর স্বাতন্ত্র, আছে, ভিক্টোরিয়ার চোখেই প্রথম তা ধরা পড়েছিল। তিনি নিজে উদ্যোগ নিয়ে প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন। সেখানেই ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে তাঁর শেষ দেখা। শেষ দেখাই শুধু নয়, ভিক্টোরিয়ার জীবন থেকে শেষ বিদায়ও বটে। আদরের উপবাস–এ রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় দেখাচ্ছেন, ভিক্টোরিয়া চিঠিতে রবীন্দ্রনাথকে লিখছেন, ‘আমার দিনগুলো কেটেছে আনন্দ ও বেদনার মধ্য দিয়ে। আনন্দ এই কারণে যে আমি তোমাকে কাছে পেয়েছিলাম। আর বেদনার কারণ, তুমি আমার নৈকট্যকে উপেক্ষা করেছ।’
এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার মন-মানসিকতার পার্থক্যও দুজনের মধ্যে হয়তো দূরত্ব তৈরি করেছিল। রবীন্দ্রনাথ আর ভিক্টোরিয়ার মন তৈরি হয়েছিল ভিন্ন দুই সমাজ ও মেজাজের আলো–হাওয়ায়।
জগদ্বিখ্যাত স্প্যানিশ চিত্রকর পাবলো পিকাসো এসবের তোয়াক্কা করেননি। তিনি ৬৪ বছর বয়সে ফ্রাঁসোয়া জিলো নামের ২১ বছর বয়সী এক মেয়ের সঙ্গে দিব্যি সম্পর্ক গড়ে তোলেন। বিয়ে না করলেও তাঁরা দুটি সন্তান নিয়েছিলেন। সন্তানদের স্বীকৃতিও দিয়েছিলেন পিকাসো। এখানেই শেষ নয়, পিকাসো ৭০ বছর বয়সে আবার প্রেমে পড়েছিলেন জেনেভিয়েভ লাপোর্ত নামে ২৪ বছর বয়সী আরেক ফরাসি যুবতীর।
প্রেমে পড়ার জন্য বয়স কোনো ব্যাপার নয়, এমনই মনে করতেন আজকের বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও খ্যাতিমান কথাশিল্পী গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস মেমোরিজ অব মাই মেলানকলি হোরস–এর (আমার স্মৃতির বিষাদ গণিকারা) নায়ক নব্বই বছর বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত জীবন কাটিয়ে হঠাৎ একটি কুমারী মেয়ের ভালোবাসা পেতে উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছিলেন এবং সেই ভালোবাসার সন্ধান পেয়ে অতীতের প্রেমহীন জীবনের অসারতাকে উপলব্ধি করেছিলেন।
শুধু বৃদ্ধ বয়সে এসে নতুন করে প্রেমে পড়া ছাড়াও ব্যাপারটা অন্য রকম করেও ঘটতে পারে। যেমন মার্কেসের আরেকটি উপন্যাস লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরায় (ভালোবাসার দিনগুলোতে প্রেম) আমরা দেখতে পাই, অল্প বয়সে প্রেমে পড়েছিল ফ্লোরেন্তিনো ও ফারমিনা নামের দুই তরুণ-তরুণী। কিন্তু একসময় ফারমিনার বিয়ে হয়ে যায় এক বিত্তবান সুদর্শন চিকিৎসক উরবিনোর সঙ্গে। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর দাম্পত্য জীবনের পর চিকিৎসক যখন মৃত্যুবরণ করে, তখন ফারমিনার কাছে আবার তার ভালোবাসা নিয়ে হাজির হয় ফ্লোরেন্তিনো, কারণ সে কখনোই ফারমিনাকে ভুলতে পারেনি। জীবনসায়াহ্নে এসে ফ্লোরেন্তিনো ও ফারমিনার চমকপ্রদ মিলন ঘটে নদীবক্ষে এক নৌযানে।
বাস্তব জীবন ও সাহিত্যের এসব উদাহরণ থেকে আমরা বলতে পারি, বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে এসে মানুষের জীবনে প্রেমের প্রাদুর্ভাবকে আমরা সমাজের চলতি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ‘অনৈতিক’ বা ‘ভীমরতি’ বলে অভিহিত করতে পারি, কিন্তু এটা িবরল বা অবাস্তব কোনো ব্যাপার নয়।
মনোরোগের চিকিৎসক আহমেদ হেলাল বলেন, প্রেম যেকোনো বয়সে হতে পারে। একে অসুস্থতা বা সমস্যা বলা যাবে না। বৃদ্ধ বয়সে পেশা ও কর্মজীবনের ব্যস্ততা কমে যায়। মানুষ ব্যক্তিজীবনে ক্রমে একাকী হয়ে পড়ে। তখন আবেগের প্রণোদনা পেলে তাঁর মধ্যে প্রেমের সঞ্চার হতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় এটাকে ‘ইকিউ’ বা আবেগাকাঙ্ক্ষা বলা হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এই আকাঙ্ক্ষা বয়সী নারীদের মধ্যেও জন্ম নিতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীরা যেহেতু সংসারের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকেন; ছেলে-বউ, মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনিদের নিয়ে ব্যস্ত জীবন কাটান, তাঁদের মধ্যে নিঃসঙ্গতার বোধ তুলনামূলক কম। পুরুষ অপেক্ষাকৃত বহির্মুখী বলে তাঁরা এ রকম আবেগের মুখোমুখি হন বেশি।
আমাদের সমাজে এ ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে ব্যক্তির জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। স্বামী-স্ত্রী-সন্তান বা আত্মীয়স্বজনের সামনে হেয় হতে হয়। নিন্দা ও বিদ্রূপের বাণে জর্জরিত হন প্রৌঢ় ব্যক্তি। কিন্তু পরিণতি বিবেচনা করে তো প্রেম আসে না।
এই প্রেমের প্ররোচনা থেকে মুক্তির উপায় কী? এর কোনো সুনির্দিষ্ট নিদান নেই। তবে পরিবারের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়ানো, নিজের দাম্পত্য সম্পর্কটিকে প্রাণবন্ত ও বৈচিত্র্যপূর্ণ করে তোলা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে রাখা ইত্যাদির মাধ্যমে বার্ধক্যের একাকিত্ব ও একঘেয়েমি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে।
১২-১৩ বছরের শিশু বা কিশোরীর সঙ্গে প্রবীণ অধ্যাপকের প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে লেখা ভ্লাদিমির নবোকভের বিখ্যাত উপন্যাস লোলিতা ১৯৫৫ সালে প্যারিসে এবং ১৯৫৮ সালে নিউইয়র্কে প্রকাশের পর এটিকে অশ্লীলতার দায়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। একটি গ্রন্থকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব, কিন্তু মানুষের একান্ত অনুভূতির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করবে কে?