করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]
সপ্তাহের শেষ দিন রোববার চিত পিঠার দাওয়াত; তা–ও আবার এই শহরের স্বনামধন্য এক শিল্পীর বাড়িতে। তার আগের সপ্তাহে আরেক ভাবির বাসাতে চিত পিঠা আর গরুর মাংসের সুবাস তখনো জিবে জল আনছিল।
সাধারণত রোববার রাতে কোথাও যেতে মন টানে না, পরদিন সকালে অফিস, ছেলেদের স্কুল, ওদের মায়ের কাজ, সবার জন্য দুপুরের খাবার তৈরি করা, এর চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে, রাত সাতটার পর থেকে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে থাকাটা মিস করতে চাই না।
ব্যাপারটা খুলেই বলি, ওই সময়টাতে নেটে বাংলা পত্রিকার মধ্যেই থাকি, ছেলেরা তো দূরের কথা, ওদের মা–ও পারত পক্ষে এই সময়টাতে ধারেকাছে ঘেঁষেই না, জানে আমি ভাবের রাজ্যে আছি (অবশ্য এটা ওরই বানানো সংলাপ—সংসারের কাজকর্ম ফাঁকি দেওয়ার উছিলা)। সে যা–ই হোক, পাছে লোকে যত কথাই বলুক, ওই ভাবের রাজ্যটুকুই আমার বিলাস, সেটা তো মিস করতে কোনোভাবেই চাই না, তো চিত পিঠা বলে কথা—‘না’ এবার করা হলো না।
কন কনে শীতের রাত, বেশ কয়েকটা জামা–জাম্পার চাপিয়ে, কানটুপি লাগিয়ে, চিত পিঠার লোভে, বিলাসী বাংলা সময়টা বাদই দিলাম। শেষ পর্যন্ত অনেক রাত পর্যন্তই গালগল্প হলো, বাসায় ফিরে ঘুমাতে যেতে যেতে বেশ রাতই হলো। এই শীতের সময়টাতে ঠান্ডার সমস্যা হয়, নাক দিয়ে অঝরে পানি পরা, গলাব্যথা, মাঝেমধ্যে গা একটু–আধটু গরম থাকা—এখানে বলে flue। দেশে থাকতেও ঠান্ডায় ঝামেলা হতো, অবশ্য তখন লুঙ্গি থাকত; সহজেই নাকটা মুছে ফেলতে পারতাম। তো এখন যখন মাঝেমধ্যে টিসু থাকে না, তখন ঝাড়ি শুনতে হয়। আগে লুঙ্গি ছিল, ভালোই হতো, টিসু একটু কম খরচ হতো।
প্রতিবছরই শীতের সময় একাধিকবার এমন হয়, তো এবার চারদিকে আরেক আতঙ্ক, কেভিড–১৯। তাই শীতের শুরুতেই টিকা নিয়েছিলাম, অবশ্য অফিস থেকে বিনা মূল্যে দিয়ে দেয়। অবশ্য সরকারেরও এতে লাভ আছে, প্রতিবছর এই শীতকালীন ভাইরাসজনিত সমস্যায় যে পরিমাণ কর্মঘণ্টার অপচয় হয়, তার চেয়ে বিনা মূল্যে টিকা দেয়াটা লাভজনক।
ফিরে আসি মূল বিষয়টাতেই, পরদিন সকালে ওই রকম একটু ঝামেলা হচ্ছিল। সকালেই বসকে মেসেজ দিলাম, ‘শরীরটা ভালো লাগছে না, মনে হচ্ছে শীতকালীন ভাইরাসজনিত সমস্যা, আজ কাজে আসব না।’
যাক, একটা দিন শুয়েবসে কাটানো যাবে। কিছুক্ষণ পরেই বসের ফোন, কী অবস্থা তোমার? যেই না উপসর্গগুলো বললাম, অমনি বলে বসলেন, এক কাজ করো, কোভিড টেস্ট করে নাও, তার ওপর তুমি তো আবার শহরের দক্ষিণে থাকো, ওই দিকটাতে নতুন করে আবার করোনার উপদ্রব দেখা দিচ্ছে। এ তো মনে হয় মাইনকা চিপায় পইড়া গেলাম। একে তো দোকানপাটে ১.৫ মিটার দূরে থাকতে হচ্ছে, হাঁচি দিলেই মানুষজনের হাঁটার গতিটাও বেড়ে যাচ্ছে, তার ওপর যদি শোনে কোভিড টেস্ট—নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মতো হয়ে যাব, ছোঁয়াতেই জাত যাবে, নাহয় ওই যে দেশ–গ্রামে ট্রাকের গায়ে লেখা থাকত—এই দুষ্ট কাছে এসো না। ওই রকম আর কি। হায়রে চিত পিঠা।
কী আর করা, নাক মুছতে মুছতেই গাড়ি চালানো শুরু করলাম। অনলাইনেই দেখলাম ধারেকাছেই সরকার বিনা মূল্যে টেস্টের জন্য একটা কেন্দ্র খুলেছে। যাক, যদি সুন্দরী একজন ডাক্তার পেয়ে যাই, রথও দেখা হবে, কলাও বেচা হবে। ওমর খৈয়াম তো সমরকন্দ, বোখারাই বেচে দিতে চাইছিলেন, নাহয় টেস্টই করালাম এক সুন্দরী এমবিবিএসের সহচর্যে। তবে শাহেদের মতো চৌকোষ প্রতারকের পাল্লায় পড়ে আইসিইউতে যাওয়ার সম্ভাবনা যে এখানে নেই, সেটা ভেবে শান্তিই পাচ্ছিলাম।
কেন্দ্রের গেটে পৌঁছাতেই চৌকস নিরাপত্তারক্ষীটা হাত তুলে গাড়ি থামাতে বলল। জানালার কাচ নামাতোই নিরাপদ দূরত্ব ১.৫ মিটার বজায় রেখেই বলল, শুভ সকাল, কেমন আছ আজ তুমি? টেস্টের কথা বলতেই বলল, ঠিক জায়গাতেই এসেছ। বাঁয়ে গিয়ে ওই গাড়িটার পেছনে লাইন ধরো।
বাঁয়ে কিছুদূর এসে বিশাল এক লাইনের পেছনে গাড়ি থামায় দাঁড়ায়ে গেলাম। একে একে লাইনটা বাড়তেই থাকে, বিএমডব্লিউ, পরসিয়া, মারসিডিস, দামি দামি সব গাড়ি একাকার সাধারণের সঙ্গে, ভেতরে সবার উদ্গ্রীব চোখের চাহনি। পাশেই উপমহাদেশীয় এক মা আতঙ্কিত চোখে ছোট্ট বাচ্চাটাকে বেবি সিটে নিয়ে বসে আছে। মহামারিটা আবার মনে করায়ে দিল যে কত অসহায় আমাদের জীবন, থাকো না পুবে কিংবা প্রাচ্যে। সাপের মতো আঁকাবাঁকা হয়ে ধীরে ধীরে গাড়িগুলো নিরাপত্তাকর্মীদের ইশারায় এগোচ্ছে।
মনে হচ্ছিল, শুধু করোনার টেস্ট নয়, ড্রাইভিং টেস্টটাও হয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত দুই ঘণ্টার মতো পার করে কেন্দ্রের দরজায় পৌঁছালাম। আমাদের উপমহাদেশীয় এক কর্মী এসে জানালা দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ে বলল, তাপমাত্রাতো স্বাভাবিকই আছে, আর কী কী উপসর্গ? সবকিছু একটা কাগজে পূরণ করে, গাড়ির সামনের কাচের ওপর গুঁজে দিয়ে, গাড়িটা বন্ধ করে, নিরাপত্তারক্ষীর ইশারার অপেক্ষায় থাকতে বলল। এবার অন্য একজন ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরিচিতিটা ভালোভাবে যাচাই করে, টেলিফোন নম্বরটা বেশ কয়েকবার জেনে নিয়ে, পরেরজনের দিকে ইশারা করে বলল, রেজাল্টটা দু-চার দিনের মধ্যে এসএমএস করে পাঠিয়ে দেব, তবে যদি খারাপ হয় ফোন পাবা, এসএমসের আশা করতে করতে পরেরজনের দিকে গাড়ি ছোটালাম; তৃতীয় জন একটা লাঠি দেখিয়ে বলল, এটা দিয়ে গলার ভেতরের লালা নেব, একটু চুলকানি লাগবে, কাশিও আসবে তারপর নাক থেকেও নাকি বাংলায়, যাকে নাকের পোটা, কোথাও নাকের শিরনি বলে, ওটা দিয়েও ভেজাবে লাঠিটা।
কী আর করার, চিত পিঠার লোভটা যদি সামলাতে পারতাম, তাহলে কী আর এই ঝামেলায় পড়তে হয়?
সবকিছু শেষ করে বলল, শোনো, এবার বাড়ি চলে যাও, চার দিন কোথাও যেয়ো না। বললাম, বউ–পোলাপান? ও হাসতে হাসতে বলল, ওদের আবার ঘর থেকে বের করে দিয়ো না।
জয় চিত পিঠা বলে বাড়ির পথে চললাম।
আসল কথটাই বলা হলো না, সেই রাতে কিন্তু চিত পিঠাটা বানানোই হয়নি।
*ক্যানবেরা, অস্ট্রেলিয়া