মরুর সুন্দরের ফিরে আসা
করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে আমরা যখন ভয়ে গৃহবন্দী, প্রকৃতি কিন্তু সে সময় একেবারেই থেমে নেই। তার অফুরান স্ফুরণ চলছে।
সরকারি কাজ থেকে আমার ছুটি, কিন্তু মরুভূমির স্থানীয় মালিকদের সঙ্গে আমি কিছু কাজ করি। এখানে যেসব বন্য প্রাণী আছে বা যারা পরিযায়ন করে, মূলত তাদের নিয়েই আমার কিছু গবেষণা। সে কারণে সব সময়ই মাঠে থাকা হয়, তবে নিয়ম-বিধি আর আইনকানুন মেনেই।
মুখোশ ও দস্তানা পরে গত ১০ মে সকাল ছয়টায় বের হয়ে গেলাম বাড়ি থেকে। মরুভূমির মূল বালুবন বাদে বাকি জায়গাগুলোতে আরবদের চার চাকা-ড্রাইভ গাড়ি অহরহ চলার কারণে পথরেখা তৈরি হয়ে থাকে। আমি সেগুলোই অনুসরণ করি। মরুভূমির কাঁকরযুক্ত বা মুক্ত মাটিময় শক্ত জমিগুলোকে এখানে বলা হয় হার্ড সাবখা। এসব জায়গায় বা বালুবনে বেশ আরামেই গাড়ি চালানো যায়। পারতপক্ষে গাড়ি থেকে নেমে বন্য প্রাণী দেখার প্রয়োজন খুব কম হয়। কিন্তু কোনো কোনো গবেষণায় পদযাত্রাই শ্রেয়।
৪০ মিনিট গাড়ি চালিয়েই ৭০ কিলোমিটার পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম মারমুম নামের মরুভূমিতে। মূল এক সড়কের পাশেই একফালি মরুভূমি। পাঁচ-ছয় বর্গকিলোমিটারের একটি সাবখা। তবে সড়কের দুই পাশে এমনভাবে গাছপালার প্রাচীর তোলা হয়েছে যে মরুদৃশ্য চোখে পড়ে না।
সাবখায় গাড়ি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই চোখে পড়ল দূরে বেশ কিছু সাদা ঢিবির মতো। কাছাকাছি গিয়ে দেখি, ওগুলো আর কিছু নয়, মরুভূমির আদি বাসিন্দা আরব অরিক্স। এক ডজনের ছোট একটা দল। রাতভর খাবার খেয়ে জাবর কাটতে কাটতে ঝিমোচ্ছে।
গাড়ির আওয়াজে প্রথম সজাগ হলো দলপতি। সেটির দেখাদেখি বাকিদেরও চাঞ্চল্য দেখা দিল। এ সাবখার প্রায় অর্ধেকটাই সবুজে বেষ্টিত। বেশির ভাগ জায়গা দখল করে আছে নোনাপানি ভরা ছোট্ট ডিম্বাকার পাতার জাইগোফাইলাম হ্যামিয়েন্সের ঝোপ। প্রাণীরা সাধারণত এটি খেতে চায় না। খাদ্যাভাব দেখা দিলে উট কিংবা কদাচ গজলা হরিণেরা এর কচি পাতা খেতে বাধ্য হয়।
চারপাশের মরু এলাকায় পেনিসেটাম ডিভিসাম ও প্যানিকাম টারজিডাম নামে তৃণভোজী প্রাণীদের প্রিয় আরও দুটি ঘাসের প্রজাতিরও ব্যাপক ফলন হয়েছে। কারণ, থেমে থেমে বৃষ্টি ঝরানো হয়েছে গত নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত। মেঘ বপন (ক্লাউড সিডিং) নামে একটি প্রক্রিয়ায় ধাবমান মেঘ থেকে জোর করে বৃষ্টি নামানো হয়। মরুভূমি সবুজ দেখাচ্ছে।
১৯৭০-এর দশকে আরব দুনিয়া থেকে আরব অরিক্স নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। কেবল অল্প কিছু নমুনা ছিল আরব বাদশাহদের ব্যক্তিগত রাজ-গোশালায়। সেখান থেকে কয়েক ডজন অরিক্স পশ্চিমা চিড়িয়াখানায় প্রজনন করিয়ে আবার আরব দেশগুলোতেই বিক্রি করা হয়। রাজ-গোশালার এবং নিয়ে আসা এই অরিক্সগুলোর প্রজনন করানো হয় ব্যাপক সংখ্যায়। তারপর ১৯৮০-র দশকের শেষ দিকে ছেড়ে দেওয়া হয় মরুভূমিতে। এদের শিকারও নিয়ন্ত্রণ করা হয় কঠোরভাবে।
গেল দুই শতকে বাংলাদেশ থেকেও হারিয়ে গেছে দুই ডজনের বেশি বন্য প্রাণী। স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে সেগুলোর একটিকেও আমরা প্রকৃতিতে প্রতিস্থাপন করার উদ্যোগ নিইনি। এমনকি এমন একটি উদ্যোগ কেন জরুরি, সে চিন্তাও আমাদের মধ্যে আসেনি। আমি মনে করি, এর জন্য দায়ী আমাদের দেশে বন্য প্রাণী বিভাগ নামে স্বতন্ত্র একটি প্রতিষ্ঠান না থাকা। বন বিভাগ দিয়ে এটি কখনোই হওয়ার নয়। বন বিভাগের কাজ আলাদা। তাদের দিয়ে এখন পর্যন্ত দখল হয়ে যাওয়া বনই উদ্ধার করা যায়নি, বিলুপ্ত বন্য প্রাণী সংরক্ষণ তো বহু দূরের বিষয়।
রেজা খান, মুখ্য বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ, দুবাই সাফারি, দুবাই মিউনিসিপ্যালিটি