করোনাভাইরাস: বিশ্ব যেভাবে বদলে যাবে (পর্ব-১)
সারা বিশ্বে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে নতুন করোনাভাইরাস। আক্রান্তের তালিকায় কোন দেশ নেই, তা খুঁজতে এখন রীতিমতো গলদঘর্ম হতে হবে। মহামারি ঠেকাতে নানা উদ্যোগ চলছে। একই সঙ্গে চলছে মহামারি–পরবর্তী বিশ্বের রূপটি কেমন হবে, তা নিয়ে নানা আলোচনা। এ নিয়ে নানা বিতর্ক হতে পারে, তবে একটা বিষয় নিশ্চিত, ভালো বা মন্দ—যেমনই হোক, এই সংকট অভাবনীয়ভাবে বদলে দেবে সামাজিক বিন্যাস।
এই করোনাভাইরাস অনেক আমেরিকানকে নাইন-ইলেভেন বা ২০০৮ সালের ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকটের মতো ঘটনাগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, যা গোটা বিশ্বের সমাজব্যবস্থাকেই দীর্ঘ মেয়াদে ঢেলে সাজিয়েছে। আমাদের ভ্রমণের অভ্যাস ও বাড়ি কেনা থেকে শুরু করে অভ্যস্ত সামাজিক নিরাপত্তার মাত্রা ও নজরদারি, এমনকি আমাদের ব্যবহৃত ভাষাতেও বদল নিয়ে এসেছে।
মার্কিন পত্রিকা পলিটিকো গত সপ্তাহে বৈশ্বিকভাবে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া নতুন করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট সংকটের প্রেক্ষাপটে ৩০ জনের বেশি বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদের মতামত নিয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্ট এই ব্যক্তিবর্গ সমাজের ওপর চলমান এ সংকটের বহুমুখী প্রভাব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছেন, যা আদতে বার্তার চেয়েও বেশি কিছু।
এই ভাইরাস মানুষকে ঘরবন্দী করে ফেলেছে। এই বন্দিত্ব এমনকি কয়েক মাসের জন্য হতে পারে। এটি এরই মধ্যে দেশে দেশে নাগরিকদের সঙ্গে সরকারের বা বহির্বিশ্বের এমনকি নিজেদের মধ্যকার সম্পর্কের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিতে শুরু করেছে। আগামী মাসগুলোয় বা বছরে এমন আরও অভাবনীয় পরিবর্তন হতে পারে বলে মনে করছেন এই বিশেষজ্ঞেরা। বিশ্বের জাতিগুলো কি এমন রুদ্ধই হয়ে থাকবে? স্পর্শ করাটা কি ট্যাবুতে রূপান্তরিত হবে? রেস্তোরাঁগুলোর কী হবে?
কিন্তু সংকট থেকেই তো সম্ভাবনার দেখা মেলে। হতে পারে তা প্রযুক্তির আরও দক্ষ ও উপযোগী ব্যবহার, কম মেরুকরণ, জীবনের ছোটখাটো সাধারণ আনন্দ-খুশিগুলো নতুনভাবে অনুভূত হওয়া। কেউ জানে না আসলে কী ঘটতে চলেছে। কিন্তু এরপরও সমাজ, সরকার, স্বাস্থ্যসেবা, অর্থনীতি, জীবনযাপনসহ নানা দিক যেভাবে বদলে যেতে পারে, তা বোঝার জন্যই এই প্রচেষ্টা।
ব্যক্তিগত মাত্রই বিপজ্জনক
দেবরাহ তানিন, ওয়াশিংটন ডিসির জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক ও লেখক। অতি সম্প্রতি বেরিয়েছে তাঁর বই—ইউ আর দ্য অনলি ওয়ান আই ক্যান টেল: ইনসাইড দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ অব উইমেন’স ফ্রেন্ডশিপস।
নাইন-ইলেভেনে মার্কিনরা বুঝতে পারল, এমন সব বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে তারাও রয়েছে, যা এত দিন তারা ভেবেছিল, শুধু দূরবর্তী দেশেই ঘটে। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকট আমাদের জানিয়ে গেল, ১৯৩০–এর দশকের মহামন্দার সময়ের দুরবস্থার মতো আগেকার দিনের বিপর্যয়ও আমাদের ভোগাতে পারে। আর এখন ১৯১৮ সালের বৈশ্বিক মহামারির অপচ্ছায়া ঢেকে ফেলেছে আমাদের জীবন।
আত্মতুষ্টি ও নিষ্পাপ মনোভাবের ক্ষয়ই এখন বিশ্বে বেঁচে থাকবার কৌশল, যা আমাদের যাবতীয় কাজকেই বদলে দিতে পারে। আমরা এখন বুঝি কোনো কিছু স্পর্শ করা, কারও সঙ্গে থাকা বা আবদ্ধ কোনো জায়গায় শ্বাস নেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এই সচেতনতা কে কত দিন ধরে রাখবে, তা একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম। কিন্তু যারা এই সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাদের মন থেকে এসব কখনোই পুরোপুরি মুছবে না। বাড়িয়ে দেওয়া হাত না ধরে বা মুখ স্পর্শ না করে পিছিয়ে আসাই আমাদের স্বভাবজাত হয়ে উঠতে পারে। আমরা সবাই আচ্ছন্ন হতে পারি বিভিন্ন সংস্কারে, কেউই হয়তো আর বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস ছাড়তেই পারব না।
কারও সঙ্গ পেলে বা কাছে এলে এখন যে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি, তার বদলে অনুপস্থিতিতেই হয়তো বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করব, বিশেষ করে যাদের আমরা চিনি না। এখন যেমনটা আমরা বলি, ‘এসব কথা কি অনলাইনে বলা ঠিক হবে?’, এর পরিবর্তে হয়তো আমরা বলতে শুরু করব, ‘এসব কথা সাক্ষাতে বলার কি কোনো দরকার আছে?’ অনিচ্ছাকৃত হলেও দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, ব্রডব্যান্ডের সুবিধা যাদের থাকবে না, তারা আরও বেশি বঞ্চিত হবে। অনলাইনে যোগাযোগের বিষয়টি আরও ব্যাপকতর হবে। এতে করে যোগাযোগ জোরদার হলেও মানুষে মানুষে দূরত্ব বাড়বে। আমরা দূরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরও বেশি অনলাইন ব্যবহার করব এবং এই দূরত্বটাকেই আমরা নিরাপদ বোধ করব।
দেশাত্মবোধের নতুন ধরন
মার্ক লরেন্স শ্যারড, ভিলানোভা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর বই ‘স্ম্যাশিং দ্য লিকার মেশিন: আ গ্লোবাল হিস্ট্রি অব প্রোহিবিশন’ প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
আমেরিকার কাছে দেশপ্রেম মানেই সশস্ত্র বাহিনী। কিন্তু ভাইরাসকে তো আর আপনি গুলি করে মারতে পারবেন না। আজকে এই করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সামনের সারিতে যাঁরা আছেন তাঁরা তালিকাভুক্ত বা ভাড়াটে সৈনিক নন, তাঁরা হলেন আমাদের চিকিৎসক, নার্স, ফার্মাসিস্ট, শিক্ষক, সেবাদানকারী, কেরানি, পরিষেবাকর্মী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা তাঁদের কর্মীরা। চীনের চক্ষুবিশেষজ্ঞ লি ওয়েনলিয়াং এবং উহানের চিকিৎসকদের মতো এঁদের অনেকের ওপরেই হঠাৎ করে চেপেছে বিপুল কাজের ভার, যেখানে সংক্রমণ, এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে। এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য এমনকি তাঁদের সম্মতিও নেওয়া হয়নি।
এই দুরূহ কাজ তাঁরা যখন শেষ করবেন, তাঁদের অবদানকে আমরা হয়তো সত্যিকারের দেশপ্রেম হিসেবে স্বীকৃতি দেব। চিকিৎসক, নার্সদের অভিবাদন জানাব—মাথা নুইয়ে বলব, ‘আপনারা যা করেছেন, তার জন্য ধন্যবাদ’, যেমনটা এখন আমরা করি সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্যদের সঙ্গে। নিজেদের স্বাস্থ্য ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা আমাদের জন্য যা করেছেন, সে জন্য তাঁদের জন্য আমরা স্বাস্থ্যসেবা এবং করপোরেট ছাড়ের ব্যবস্থা করব। আমাদের জন্য জীবন উৎসর্গ করা এই মানুষদের জন্য আমরা ভাস্কর্য বানাব এবং ভোগ করব ছুটিও। সম্ভবত অবশেষে আমার এটা বুঝতে শিখব যে কোনো জাতিগোষ্ঠীকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার চেয়ে বরং কারও স্বাস্থ্য ও জীবনের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করাই দেশপ্রেম। এই মহাবিপর্যয়ের অন্যতম সুফল হবে সম্ভবত আমেরিকান দেশপ্রেমের বেসামরিকীকরণ এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসা।
মেরুকরণ কমে যাবে
পিটার টি. কোলম্যান, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের এ অধ্যাপক কাজ করেন অনুসরণযোগ্য সংঘাত নিয়ে। তাঁর নতুন বই ‘দ্য ওয়ে আউট: হাউ টু ওভারকাম টক্সিক পোলারাইজেশন’ প্রকাশিত হবে ২০২১ সালে।
করোনা মহামারি আমাদের গোটা ব্যবস্থার ওপর এক ভয়ানক অভিঘাত সৃষ্টি করেছে। এর ফলে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মেরুকরণের যে ধারায় যুক্তরাষ্ট্র আটকে পড়েছে, তা থেকে আমাদের বের হয়ে আসার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এটি আমাদের বৃহত্তর জাতীয় সংহতিতে সহযোগিতা করবে। এসব কথা শুনতে আদর্শবাদী মনে হলেও এমন অনুমানের পেছনে অন্তত দুটি কারণ রয়েছে।
প্রথম কারণটি হলো, ‘অভিন্ন শত্রুর’ প্রেক্ষাপট, যা মানুষকে নিজেদের মধ্যে থাকা পার্থক্য ভুলে একই বহিঃশত্রুর সঙ্গে যূথবদ্ধভাবে লড়ার মানসিকতা দেয়। কোভিড-১৯ আমাদের সামনে এমন ভয়ানক এক শত্রু হয়ে হাজির হয়েছে, যা ভেদাভেদ করবে না এবং একই সঙ্গে তা আমাদের একীভূত হওয়ার তুমুল শক্তি জোগাতে পারে এবং নতুন করে সংঘবদ্ধতার উদ্দেশ্য অনুধাবনে সহায়তা করতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনে নাৎসি বাহিনীর ৫৬ দিনের বোমাবর্ষণ ও হামলার সেই মহা-আক্রমণের কালে উইন্সটন চার্চিলের মন্ত্রিসভা একই সঙ্গে যেমন হতবুদ্ধি হয়েছিল তেমনি মানুষের পরহিতৈষিতা, সহানুভূতি, উদারতা ও সক্রিয়তায় অভিভূত হয়েছিল।
দ্বিতীয় কারণ হলো ‘রাজনৈতিক অভিঘাত’। গবেষণায় দেখা গেছে, বড় ধরনের অভিঘাতে মজবুত ও ঋজু কাঠামোরই বদলে যাওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। তেমনটা যে এখনই হতে হবে, তা নয়। তবে ১৮১৬ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যকার সময়ে আন্তরাষ্ট্রীয় ৮৫০টি দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, অস্থিতিশীলতার অভিঘাত শেষ হতে ৭৫ শতাংশের বেশি ক্ষেত্রে ১০ বছরের বেশি সময় লেগেছে। সামাজিক অভিঘাতের ফলাফল বিভিন্ন রকম হতে পারে। এতে ভালোও হতে পারে, আবার মন্দও হতে পারে। কিন্তু আমাদের বর্তমান সংকটের যে মাত্রা, তা আমাদের বলছে, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিকাঠামো আরও গঠনমূলকভাবে বিন্যস্ত করার এটাই সময়। পরিবর্তনের সময় যে ঘনিয়ে আসছে, তা পরিষ্কার।
আস্থা ফিরবে বিশেষায়িত জ্ঞানের প্রতি
টম নিকোলস, ইউএস নেভাল ওয়ার কলেজের অধ্যাপক এবং ‘দ্য ডেথ অব এক্সপার্টাইজ’ বইয়ের লেখক
বহু বছর ধরে আমেরিকা গুরুত্বপূর্ণ কোনো কিছুকেই তেমন গুরুত্ব দেয় না। মূলগতভাবেই একটি উদাসীন দেশে পরিণত হয়েছে দেশটি। শান্তি, সম্পদ ও ভোগ্যপণ্যের প্রাচুর্যের বদৌলতে এই বিলাসিতা সম্ভব হয়েছে। পরমাণুযুদ্ধ, জ্বালানি তেলের স্বল্পতা, বেকারত্বের উচ্চ হারের মতো একসময় যেসব বিষয় মনকে আচ্ছন্ন করে রাখত, তা নিয়ে আমাদের আর ভাবার দরকার হতো না। এসবের জায়গায় জাতীয় হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছিল সন্ত্রাসবাদ। তা মোকাবিলায় আমরা সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছাসেবী পাঠিয়েছি, তারা বিশ্বের প্রত্যন্ত কোনো মরুভূমিতে কাজ করেছেন মাতৃভূমির রক্ষক হিসেবে। এমনকি আমরা টেলিভিশনের রিয়েলিটি শোর এক তারকাকে প্রেসিডেন্ট বানিয়েছি, যা ছিল সরকারকে প্রতিনিয়ত সক্রিয় রাখা আমলাতন্ত্র ও বিশেষায়িত জ্ঞানের ওপর এক বড় আঘাত।
কোভিড-১৯ সংকট এই পরিস্থিতিকে দুভাবে বদলে দিতে পারে। প্রথমত, এই সংকট এরই মধ্যে মানুষকে বিশেষায়িত জ্ঞান গ্রহণে বাধ্য করেছে। এই মহামারির আগ পর্যন্ত বিশেষজ্ঞদের প্রতি নাক সিটকানো সহজ ছিল। আর এখন মানুষ অ্যান্থনি ফাউসির মতো চিকিৎসা বিশেষজ্ঞের কথা শুনতে চাইছে। দ্বিতীয়ত, এই সংকট থেকে আমেরিকানরা নতুন করে সবকিছুর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে। অথবা, তারা অন্তত নতুন করে বুঝতে শিখবে যে সরকার চালানো ওজনদার লোকের কাজ। আমেরিকানদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখা এবং অর্থনীতিতে মহামারির বেসামাল প্রভাব সামলে উঠতে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রকাণ্ড ব্যর্থতা মানুষকে অন্তত এই অনুভূতিটুকু দেবে যে সরকার শুধু আবেগকে পরিতৃপ্ত করার জন্য নয়; তার চেয়ে বেশি কিছু।
চাপে পড়বে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ
এরিক ক্লিনেনবার্গ, নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও ইনস্টিটিউট অব পাবলিক নলেজের পরিচালক। তাঁর সর্বশেষ বই ‘প্লেসেস ফর দ্য পিপল: হাউ সোশ্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার ক্যান হেল্প ফাইট ইনইকুয়ালিটি, পোলারাইজেশন, অ্যান্ড দ্য ডিক্লাইন অব সিভিক লাইফ’।
করোনাভাইরাস মহামারি বাজার-সংস্কৃতি ও অতিমাত্রায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সঙ্গে আমাদের ভালোবাসার অবসান হতে পারে। আমরা কর্তৃত্ববাদের দিকে ঝুঁকতে পারি। কল্পনা করুন যে আগামী নভেম্বরের নির্বাচন স্থগিত করার চেষ্টা করছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সামরিক হস্তক্ষেপের কথা বিবেচনা করুন। চরম নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রের বিষয়টি এখন বাস্তব। কিন্তু আমার বিশ্বাস, আমরা এগোব ভিন্ন দিকে। বাজারকেন্দ্রিক সামাজিক সংস্থার বিপর্যয়কর ব্যর্থতা আমরা লক্ষ করছি। ট্রাম্প থেকে শুরু করে সবার আত্মকেন্দ্রিক আচরণ এই সংকটকে আরও ভয়ানক রূপ দিয়েছে।
সংকট শেষে আমরা আমাদের রাজনীতিকে ঢেলে সাজাব এবং জনস্বাস্থ্য ও পরিষেবার মতো জনকল্যাণমূলক কাজে উল্লেখযোগ্য নতুন বিনিয়োগ করব। আমি মনে করি না যে আমাদের সাম্প্রদায়িকতা কমবে। তবে আমাদের সবার ভাগ্য যে একসূত্রে গাঁথা, তা আরও ভালোভাবে বুঝব আমরা। যে রেস্তোরাঁ থেকে আমি সস্তায় বার্গার খাই, সেখানকার ক্যাশিয়ার যেমন পান না সবেতন ছুটি কিংবা তাঁর রান্নাঘরের কর্মীরা বাড়িয়ে দেন অসুস্থতার ঝুঁকি, ঠিক তেমন করেই এই মহামারিতে ঘরে না থেকে আমার প্রতিবেশী আমার ঝুঁকি বাড়াচ্ছেন, যাকে আমাদের স্কুলগুলো বিজ্ঞানমনস্ক ও চিন্তাশীল ভাবনায় দক্ষ করতে পারেনি। মহামারির কারণে সৃষ্ট মন্দায় চাকরি হারানো লাখো কর্মীর উপার্জনের নিশ্চয়তা যদি সরকার দিতে না পারে, তাহলে অর্থনীতি ও সামাজিক শৃঙ্খলা ধসে যাবে। সরকার ছাত্রদের ঋণ না কমালে বা বাতিল না করলে তরুণেরাও নতুন করে কিছু করতে পারবে না। ভয়ানক এক দুর্ভোগের সৃষ্টি করতে চলেছে করোনাভাইরাস মহামারি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি আমাদের নিজেদের নতুন করে জানতে, মূল্যায়ন করতে বাধ্য করবে। দীর্ঘ মেয়াদে নিজেদের ভালো দিকটা খুঁজে পেতে সহায়তা করবে এই সংকট।
ধর্মীয় উপাসনার ধরন বদলে যাবে
অ্যামি সুলিভান, ভোট কমন গুড-এর কৌশলগত পরিচালক
খ্রিষ্টানদের অনেকেই বলতে ভালোবাসেন যে আমরা ‘ইস্টার পিপল’। আশাবাদের জয় হবেই এবং জীবন হবে শঙ্কামুক্ত—এই বিষয়টিতে জোর দিতেই তাঁরা এ কথা বলেন। কিন্তু ইস্টারের সকালে সবাই মিলে আনন্দ-উল্লাস করতে না পারলে তাঁরা পবিত্রতম দিনটি উদ্যাপন করবেন কীভাবে? পাসওভার সিডার যদি (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম) জুমে পালন করতে হয়, তাহলে ইহুদিরা কীভাবে দাসত্বের বন্ধন থেকে পরিত্রাণের উৎসব উদ্যাপন করবে। তারাবিহ পড়তে যদি মসজিদে যেতে না পারে এবং পরিবার-পরিজন নিয়ে একসঙ্গে ইফতার করতে না পারে, তাহলে মুসলিমেরাই-বা কীভাবে রমজান পালন করবে?
যুদ্ধবিগ্রহের সময় প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিশ্বাস বজায় রাখতে সব ধর্মবিশ্বাসীকেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। সব ধর্মবিশ্বাসকেই অবশ্য একসঙ্গে এমন পরিস্থিতিতে সাধারণত পড়তে হয় না। কোয়ারেন্টিনের এই সময় ধর্মের উপাসনার রীতি ও উপাস্য—দুই ধারণাকেই চ্যালেঞ্জ করবে। তবে স্থানীয়ভাবে ধর্মসভা করার ব্যবস্থা যাদের নেই, এই পরিস্থিতি তাদের জন্য দূরবর্তী স্থান থেকে ধর্মীয় বক্তৃতা প্রচারের সুযোগ করে দেবে। ধ্যানচর্চার জনপ্রিয়তা বাড়তে পারে। সবার মঙ্গলের কথা প্রচার করেন—এমন ব্যক্তিদের সামাজিক মর্যাদা অনেক বাড়বে।
সংস্কারের নতুন কাঠামো
জোনাথন রাউচ, ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো ও মার্কিন সংবাদমাধ্যম আটলান্টিকের নিয়মিত লেখক
মার্কিনদের একটি অংশের রূপান্তরমূলক মহামারির মধ্য দিয়ে যাওয়ার সাম্প্রতিক স্মৃতি রয়েছে: আর দলটি হচ্ছে সমকামীরা। করোনাভাইরাসের চেয়ে সবদিক দিয়েই এইচআইভি/এইডসের পার্থক্য ছিল এবং আছে। তবে একটি শিক্ষা প্রযোজ্য হতে পারে যে প্লেগ দিক পরিবর্তন করেছে। সমকামী আমেরিকানরা এক হয়ে সংগঠন, নেটওয়ার্ক করেছে। তারা জানে, ওই বিষয়গুলো সমাজে আমাদের অবস্থান কীভাবে পাল্টে দিয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারি আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ভয়াবহ ত্রুটিগুলোও প্রকাশ করেছে এবং এটা বিয়ের সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিতে আমাদের জাগিয়ে তুলেছে। এটা (করোনাভাইরাস) মাইলফলক সংস্কারের বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে।
করোনাভাইরাসের এই সময়ে কিছু অ্যানালগ পরিবর্তন দেখতে পেলেও তা বিস্ময়কর ঠেকবে না। এই দুর্দশার মধ্যেও মানুষ একে অপরকে সমর্থন দিতে এবং সংযোগ স্থাপন করতে নতুন নতুন উপায় খুঁজছে। তাঁরা নিশ্চিতভাবে স্বাস্থ্যসেবা সিস্টেমে বড় বড় পরিবর্তন আনার দাবি তুলবেন। হতে পারে তাঁরা সরকার পরিবর্তনেরও দাবি তুলতে পারেন। আর তাঁরা হয়ে উঠবেন পরস্পর নির্ভরশীল ও সম্প্রদায়ের নতুনভাবে সচেতন একটি পক্ষ। এর যথাযথ প্রভাবের বিষয়টি এখন অনুমান করা যাচ্ছে না। তবে নিশ্চিত যে এটা কয়েক বছরের মধ্যে দেখতে পাওয়া যাবে।
অনলাইন টুলের নিয়ন্ত্রণমূলক বাধা ভেঙে পড়বে
ক্যাথেরিন ম্যাংগু-ওয়ার্ড, রিজন ম্যাগাজিনের এডিটর-ইন-চিফ
কোভিড-১৯ আমাদের আরও বেশি অনলাইন জীবনের দিকে ঝুঁকে পড়তে অনেক কৃত্রিম বাধা দূর করবে। তাই বলে সবকিছু ভার্চ্যুয়াল হয়ে উঠবে এমন নয়। আমাদের জীবনের অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত কার্যকর অনলাইন টুলগুলোকে ক্ষমতাধরেরা অতিসাবধানী আমলাদের সহায়তায় অতি ধীরগতির করে রেখেছে। যেমন মার্কিনদের ক্ষেত্রে মেডিকেয়ারের (বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা) আওতাধীন ব্যক্তিদের জন্য টেলিমেডিসিন (ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চিকিৎসকের পরামর্শ পাওয়া) চালুর দাবি রয়েছে অনেক দিনের। তাৎক্ষণিকভাবে বলা যায়, মার্কিনদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা বহনযোগ্য এবং জবাবদিহি আইন হিপার (হেলথ ইনস্যুরেন্স পোর্টেবিলিটি অ্যান্ড অ্যাকাউন্টেবিলিটি অ্যাক্ট, ১৯৯৬) কাছে অন্য স্বাস্থ্যসেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো সবার কাছে ই-মেইল, স্কাইপে, ফেসটাইমের মতো টুল ব্যবহার করে একই ধরনের সেবা পৌঁছে দেওয়ার অনুমোদন চাইতে পারে। এই সংকটের সময়ে বিষয়টি কার্যকর না হলে নিয়ন্ত্রক আমলাতন্ত্র তা আরও বহু বছর টেনে নিয়ে যাবে।
শিক্ষক ইউনিয়ন ও তাদের সমর্থন করা রাজনীতিকেরা দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ঘরে বসে বা অনলাইনে আংশিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর ধারণার যে বিরোধিতা করেছিল, তা এই সংকটের মুখে ভেসে গেছে। এখন অনলাইন হোমওয়ার্ক ও ঘরে থেকে আংশিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর যে স্বাদ পরিবারগুলো পেয়েছে এবং তাকে তারা যেভাবে গ্রহণ করেছে, তাতে একে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। শূন্য ক্যাম্পাসে হোস্টেলে ফেরার আগ্রহ অনেক কলেজ শিক্ষার্থীরই হবে না। এতে এই খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে বাধ্য হবে, যার প্রয়োজনীয়তা অনেক আগে থেকেই অনুভূত হচ্ছিল।
আর চাকরির ক্ষেত্রে বলা যায়, সব অফিসই দূরবর্তীভাবে করা যায় না। তবে অনেক মানুষই শিখছেন যে বাড়ি থেকে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার জন্য এক-দুটি অ্যাপ ডাউনলোড করা এবং বসের অনুমতি আদায় ছাড়া আর কিছু লাগে না। একবার যদি প্রতিষ্ঠানগুলো এমন দূরবর্তী কাজের পদক্ষেপ নেয়, তাহলে একটা সময়ে কর্মীদের জন্য সেই ব্যবস্থা বাতিল করাই তাদের জন্য কঠিন ও ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে। অন্যভাবে বলা যায়, বিরক্তিকর এত এত মিটিং (চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট এবং শিক্ষার্থীদের ক্লাস) সত্যিকারভাবে ই-মেইলের মাধ্যমে হতে পারত। আর এখন তাই হতে যাচ্ছে।
(চলবে)
(অনুবাদ করেছেন: ফারুক হোসেন, শেখ সাবিহা আলম, নাজনীন আখতার, তপতী বর্মন, শুভা জিনিয়া চৌধুরী, ফজলুল কবির, সাইফুল ইসলাম, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, শাকিলা হক, রাজিউল হাসান ও অর্ণব সান্যাল।)