যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে ডোনাল্ড ট্রাম্প বসার পর থেকেই তেহরান-ওয়াশিংটন সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। ২০১৯ সালে এই সম্পর্ক বৈরিতায় গিয়ে ঠেকে। বিগত বছরটিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যকার সম্পর্ক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে, যা এ বছর (২০২০ সাল) আরও খারাপের দিকে মোড় নিতে পারে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকেরা।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছায় যুক্তরাষ্ট্র। ছয় জাতি চুক্তি হিসেবে পরিচিত এ চুক্তিতে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া রয়েছে রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি। ২০১৮ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র এই পারমাণবিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার এবং ইরানের ওপর আগের সব নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহালের ঘোষণা দেয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প সরাসরিই ইরানের ওপর ‘সর্বোচ্চ চাপ’ প্রয়োগের নীতির কথা ঘোষণা করেছেন।
এর অংশ হিসেবে তেহরানের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা কয়েক গুণ বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি বাকি বিশ্বের সঙ্গে ইরানের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং দেশটির জ্বালানি তেল বিক্রয়লব্ধ রাজস্ব আয় কমানোর সব ধরনের চেষ্টাই করছে যুক্তরাষ্ট্র। মূল লক্ষ্য ইরানকে ভেতর থেকে ভেঙে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য করা। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরানও নিজেদের নীতি ‘সর্বোচ্চ সহনশীলতা’ থেকে ‘সর্বোচ্চ প্রতিরোধে’ বদলে নিয়েছে। এখন পর্যন্ত সীমিত সম্পদ নিয়েই কৌশলগত নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে ইরান ভালোভাবেই মার্কিন বৈরী নীতি মোকাবিলা করে যাচ্ছে।
ইরান-যুক্তরাষ্ট্র দ্বৈরথে স্পষ্টত দুটি পক্ষ রয়েছে। এর একদিকে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল-সৌদি আরব। অন্য পক্ষটি স্পষ্ট না হলেও সেদিকে ইরানের সঙ্গে রাশিয়া ও চীনের মৈত্রী রয়েছে। এরই নিদর্শন হিসেবে ভারত মহাসাগর ও ওমান সাগরে এই তিন দেশ যৌথ সামরিক নৌ মহড়া চালিয়েছে সম্প্রতি। ওয়াশিংটনের সঙ্গে দ্বৈরথের অংশ হিসেবে হলেও এর কারণ হিসেবে ইরান মস্কো-বেইজিং-তেহরানের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারের কথা বলছে।
এই যখন প্রেক্ষাপট, তখন ২০২০ সালে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার নিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের বছর হওয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিরাপত্তাসহ নানা দিকে নিজের সক্ষমতা ও শক্তি প্রদর্শনের অংশ হিসেবে এ পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তুলতে পারেন।
এ সম্পর্কিত এক বিশ্লেষণে মার্কিন সাময়িকী ফরেন পলিসি বলেছে, ২০১৮ সালে চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার ও ইরানের ওপর আরও বেশি মাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আরোপের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের নীতি নিয়েছে, তার কোনো সুফল এখন পর্যন্ত তারা পায়নি। চাপের মুখে ইরান ভেতর থেকে যেমন ভেঙে পড়েনি, তেমনি কূটনৈতিক আত্মসমর্পণও তারা করেনি। সম্প্রতি তেহরানে তরুণদের বিক্ষোভ সংঘটিত হলেও তা আপাতত দেশটির প্রশাসন সামাল দিতে পেরেছে বলেই মনে হচ্ছে।
উপরন্তু চুক্তি লঙ্ঘনের কারণ দেখিয়ে তেহরান আবার তার পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি চালু করেছে। একই সঙ্গে আঞ্চলিক পরিসরে বৈরী পক্ষগুলোকে নিজের শক্তিও প্রদর্শন করছে। ফলে অবধারিতভাবেই ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনা বেড়েছে। সিরিয়া ও লেবাননে দুই পক্ষ এরই মধ্যে একাধিকবার মুখোমুখি হয়েছে। এ অবস্থায় বড় কোনো পরিবর্তন না হলে ২০২০ সালে এ দ্বৈরথ আরও জোরদার হবে। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ইরান-নীতি দেশটিতে কট্টরপন্থীদের শক্তি জোগাচ্ছে, যার দায় পুরো বিশ্বকেই চোকাতে হতে পারে।
বারাক ওবামা প্রশাসনের শেষ কয়েক বছর বাদ দিলে ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যকার সম্পর্ক শেষ কবে ভালো ছিল, তা খুঁজতে হলে ইতিহাসের অনেক পেছনে চলে যেতে হবে। সেই ১৯৭৮ সালে যখন ইরানের নেতৃত্বে ছিলেন মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভি, আর মার্কিন নেতৃত্ব ছিল জিমি কার্টারের হাতে। ওই বছর এক নৈশভোজে ইরান-মুগ্ধ জিমি কার্টার দেশটি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বিশ্বের সবচেয়ে সংকটপূর্ণ অঞ্চলের সবচেয়ে স্থিতিশীল দেশ।’ কিন্তু এ ইতিবাচক মনোভাব বদলাতে সময় লাগেনি। ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পাহলভি বিদায় নিলে ক্ষমতায় বসে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খমেনির সরকার। সেই সময় যেমন কারও পক্ষে কল্পনা করা দুঃসাধ্য ছিল যে শাহদের বিদায় করে দীর্ঘদিনের জন্য ইরানের ক্ষমতা চলে যাবে ইসলামিস্টদের হাতে। ঠিক তেমনি কয়েক বছর আগেও বোঝা সম্ভব ছিল না যে মাত্র গলতে শুরু করা বরফ আবার শুধু জমাটই বাঁধবে না, তৈরি হবে যুদ্ধাবস্থা।
২০১৯ সালে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক সত্যিই এমন ভয়াবহ অবস্থায় উপনীত হয়েছিল। গত জুনে ইরানে বোমা হামলার নির্দেশ প্রায় দিয়েই ফেলেছিল ওয়াশিংটন। মার্কিন ড্রোনকে ভূপাতিতও করেছিল তেহরান। ফলে অবধারিতভাবেই যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয় দুই দেশের মধ্যে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রকৃত যুদ্ধ এড়ানো গেছে। এর দুই মাস পর সেপ্টেম্বরে আবার একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন দুই মিত্র সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) জ্বালানি তেলবাহী জাহাজে ইরান হামলা চালালে। এই যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতি ২০২০ জুড়েও অব্যাহত থাকবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
আগামী বছর যুক্তরাষ্ট্র ইরান বিষয়ে তার নীতি থেকে সরে আসবে না বলেই মনে হচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ তাঁর প্রশাসনের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তির বক্তব্য অন্তত তা–ই বলে। ট্রাম্প তো বলেছেনই, ‘তারা (ইরান) ভেঙে পড়েছে।’ মোটাদাগে এটিই যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, যুক্তরাষ্ট্র আশা করছে, ২০২০ সালেই ইরান তার যাবতীয় প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে বসবে। এমন ভাবার কারণও অবশ্য তাদের আছে। বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও মিত্রদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে ইরানকে বাকি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সবকিছুই করছে যুক্তরাষ্ট্র। বৈশ্বিক অর্থনীতি থেকে ইরানকে মোটামুটি একঘরে করে ফেলেছে ওয়াশিংটন। দেশটির জ্বালানি তেল রপ্তানির পরিমাণ প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দেশটিতে বিক্ষোভ দেখা দিলেও ইরান যে এখনো ভেঙে পড়েনি, তা তো প্রমাণিত। ধারণা করা হচ্ছে, অন্তত দুই বছর টিকে থাকার মতো যথেষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে দেশটিতে। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করে আসা দেশটির অভিজ্ঞতাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
সবকিছু মিলে ইরানের ক্ষমতায় যুক্তরাষ্ট্র যে বদল চাইছে, তার দেখা ২০২০ সালে তারা পাবে না বলেই মনে হচ্ছে। বরং, চাপ প্রয়োগের নীতির কারণে নিরাপত্তার বিষয়টিই এখন দেশটির কাছে প্রধান হয়ে উঠছে। ফলে সামনের বছর তেহরানে রক্ষণশীল ও কট্টরপন্থী নেতৃত্বের ভিত আরও শক্ত হবে। ইকোনমিস্ট বলছে, পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছাতে পারে যে আহত সিংহের মতো ইরান হয়তো মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন মিত্রদের অস্থির করে তোলার পাল্টা নীতি আরও জোরদার করবে। বিশেষত ইয়েমেন ও ইরাকে থাকা দেশটির সহায়তাপুষ্ট অংশ মার্কিন ঘাঁটি ও মার্কিন মিত্রদের ওপর আরও বেশি হামলা করবে।
তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতির উন্নতিও হতে পারে। প্রথমত, কাতারের সঙ্গে সংকট মীমাংসায় সৌদি জোটের আগ্রহ বাড়ছে। একই সঙ্গে ইয়েমেনে দীর্ঘমেয়াদের যুদ্ধে ক্লান্ত সৌদি আরব একটু পিছু হটতে চাইছে বলেই মনে হচ্ছে। বিশেষত তার অন্যতম বড় মিত্র ও শক্তির উৎস ইউএই সুস্পষ্টভাবে ইয়েমেন থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছে। এ অবস্থায় ইয়েমেন সংকটের উন্নতি হলে তা আঞ্চলিক সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আবার ‘আরও ভালো চুক্তি’ করার কথা বারবার বলছেন ট্রাম্প। ইরানের নেতার সঙ্গে বৈঠকের প্রচ্ছন্ন বার্তাও তিনি দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু এখানে বাদ সাধছে ‘নিষেধাজ্ঞা’। ইরানে প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি অবশ্য বলে দিয়েছেন, ‘নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আগে কোনো আলোচনা নয়।’ দুই পক্ষের মধ্যে একটি শান্তিপূর্ণ আলোচনার জন্য স্পষ্টত দুই দেশের কট্টরপন্থীরাই বড় বাধা। এই বাধা অতিক্রম করে একটি স্থিতিশীল পরিস্থিতি আসার সম্ভাবনা খুব একটা নেই বলেই মনে করা হচ্ছে। মূল বাধা—ওয়াশিংটনের অতি চাহিদা এবং ওয়াশিংটনের প্রতি ইরানের অবিশ্বাস।