ইন্দিরার পথে নরেন্দ্র মোদি?
গত বছরের শেষের দিকে বেশ বেকায়দায় পড়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভোটের মাঠে তিনটি রাজ্যের স্থানীয় নির্বাচনে নাকাল হয়েছিল তাঁর দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। কিন্তু ছয়-সাত মাসের মধ্যেই তা সামলে নিয়েছেন মোদি। তবে কি মোদিই আসছেন আবার ক্ষমতায়? প্রশ্নটা ঘুরেফিরে চলে আসছেই।
যদিও ২৩ মের আগে এই প্রশ্নের নির্ভুল উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে নরেন্দ্র মোদি যে আবার ‘ফর্মে’ ফিরে এসেছেন, তা বলাই যায়। সমালোচকেরা বলছেন, মুখে কংগ্রেসের কঠোর সমালোচনা করলেও আদতে সাবেক কংগ্রেস নেত্রী ও ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পদাঙ্কই অনুসরণ করতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদি। গুজরাটের সাবেক মুখ্যমন্ত্রীর আগে ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে সবার ওপরে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। জওহরলাল নেহরুর কন্যা দলকেন্দ্রিক রাজনীতির বাইরেও নিজের তুমুল ব্যক্তি জনপ্রিয়তা গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর পর ভারতের আর কোনো প্রধানমন্ত্রী যদি সত্যিকার অর্থেই আলোচিত হয়ে থাকেন, তবে তিনি হলেন নরেন্দ্র মোদি।
ইন্দিরা গান্ধীর সমালোচকেরা তাঁর শাসনপদ্ধতিকে ‘একনায়কতান্ত্রিক’ বলে অভিহিত করে থাকেন। ১৯৭৫ সালের জুন থেকে ১৯৭৭ সালের মার্চ পর্যন্ত ভারতে অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। জরুরি অবস্থা জারি থাকার সময়ে বিরোধী দলের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কণ্ঠ রোধ করা হয়েছিল সংবাদপত্রের। নাগরিক অধিকার সংকুচিত হয়েছিল। ইন্দিরা যুক্তি দিয়েছিলেন এই বলে যে ভারতের তৎকালীন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বাগে আনার জন্য সাময়িকভাবে এই জরুরি অবস্থা প্রয়োজন ছিল। অবশ্য বিরোধীরা সব সময়ই তা নাকচ করে এসেছে।
ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হতো প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে। সেটি হয়ে উঠেছিল প্রশাসনিক ক্ষমতার আধার। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সময়ও চিত্র একই। ২০১৪ সালে ২৮২টি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে মোদির বিজেপি। নিউইয়র্ক টাইমসের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, এরপর থেকে ক্রমেই নিজের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেছেন মোদি। তাঁর সরকার কিছু ক্ষেত্রে সংসদকে পাশ কাটিয়ে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বিভিন্ন নীতি বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়েছে। নানা শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে অযোগ্য হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে। এমনকি বিচারকদের নিয়োগের ক্ষেত্রেও নিয়ন্ত্রণ জারির চেষ্টা করা হয়েছে। সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংস হামলা চালানো হয়েছে হরহামেশা। হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের হাতে খুন হয়েছেন বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকও।
অথচ যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন মোদি, তার কোনোটিই পূরণ করেননি তিনি। ভারতে বেকারত্বের হার গত কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। দেশটির কৃষি খাত পিছিয়ে গেছে ঢের, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকেরা। দলিত ও নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। তাঁদের অভিযোগ, মোদি সরকার শুধু উঁচু বর্ণের হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষা করছে।
তবে এসব কিছুকে পাশে ঠেলে পাকিস্তানবিরোধী বক্তব্যে জনসভা মাতাচ্ছেন মোদি। সাধারণ মানুষের মন তাতে ভুলছেও। এর পাশাপাশি হিন্দু জাতীয়তাবাদী বক্তব্যও দিচ্ছেন মোদি, কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর বাবা তুলে কটু কথা বলতেও ছাড়ছেন না। এককথায় রাজনৈতিক শিষ্টাচারের ধার ধারছেন না ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। অন্যদিকে নিজের দল থেকে মনোনয়ন দিচ্ছেন ২০০৮ সালে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর অভিযোগ থাকা ব্যক্তিকেও। অর্থাৎ ভোটের মাঠে নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রদায়িক চরিত্র একেবারে স্পষ্ট।
নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দল বিজেপির রাজনীতি অবশ্য সব সময়ই এমন বিভক্তি সৃষ্টিকারীই ছিল। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করা হয়েছে নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে। সেখানে তাঁকে ‘ইন্ডিয়া’স ডিভাইডার ইন চিফ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। মূল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে বর্তমানে গণতন্ত্র লোকরঞ্জনবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। মোদির সরকারের আমলে ভারতের সব ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ফলে দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি হুমকিতে আছে। ভারতে একধরনের বিষাক্ত ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটছে।
প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়ে এবং ভারতের অতি পরিচিত ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি সচেতনভাবে ধ্বংস করার চেষ্টা করেও পুনর্নির্বাচনের প্রতিযোগিতায় বেশ ভালোভাবেই টিকে আছেন নরেন্দ্র মোদি। উল্টো কিছুটা সুবিধাতেই আছেন তিনি। ভারতের বেশির ভাগ টেলিভিশন চ্যানেলগুলো মোদির প্রচারে ব্যস্ত। সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার অপব্যবহারের অভিযোগও উঠেছে মোদির বিরুদ্ধে। নির্বাচনের আগ দিয়ে নমো অ্যাপ ও নমো টিভি চালু করেছেন তিনি। এসব অ্যাপ্লিকেশন বিভিন্ন নতুন ব্র্যান্ডের মোবাইলে প্রিলোডেড থাকছে।
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, সরকারে থাকার সুবিধা পুরোটাই কাজে লাগাতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদি। ভোট গ্রহণ সামনে রেখে বিরোধী নেতাদের লক্ষ্য করে চালানো হচ্ছে কর কর্মকর্তা ও পুলিশের নানা অভিযান। অনেক আগের ফাইলবন্দী অভিযোগ আবার জ্যান্ত হচ্ছে। ২০১৫ সালের এক ঘটনাকে সামনে এনে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর নাগরিকত্ব নিয়ে বিতর্ক উসকে দেওয়া হয়েছে। আর ভোটের মৌসুম শুরু হওয়ার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্ষুদ্র কৃষকদের ব্যাংক হিসাবে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে নগদ অর্থ, বলা হচ্ছে এটি মোদি সরকারের নতুন সহায়তা স্কিম।
অর্থাৎ পুরো সরকারযন্ত্রকে পাশে নিয়ে মাঠে খেলতে নেমেছেন নরেন্দ্র মোদি। বাড়তি সুবিধা তিনি ভোগ করছেন, এটি সত্যি। ওদিকে ফোর্বস জানাচ্ছে, মোদির ফের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে মানছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও। নোট বাতিল ব্যর্থ হলেও নতুন কর ব্যবস্থা জিএসটি বিতর্কিত হলেও ব্যবসায়ীদের ঠিকই পাশে পাচ্ছেন মোদি। তবে হ্যাঁ, মোদির বিজেপির একচ্ছত্র আধিপত্য যে খর্ব হবে এবার, সেটিও মেনে নিচ্ছে সবাই।
হিসাব বলছে, এখন পর্যন্ত একক রাজনৈতিক দল হিসেবে সবচেয়ে বেশি আসন দখলে থাকবে বিজেপির। তবে তা আগের মতো ‘বিশাল’ হবে না। কিন্তু জোটসঙ্গীদের নিয়ে ঠিকই সরকার গঠন করতে পারবেন নরেন্দ্র মোদি। এর বিপরীতে দাঁড়াতে হলে এক হতে হবে কংগ্রেসসহ সব বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে। সেই কঠিন কাজটি সম্ভবপর হলেও তাতে গঠিত জোট সরকারের স্থায়িত্ব ও স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। মার্কিন থিংক ট্যাংক কার্নেগির কর্মকর্তা মিলন বৈষ্ণব বলছেন, মোদির ব্যক্তিগত ক্যারিশমা ও জনপ্রিয়তা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ইস্যু ও বিরোধী শিবিরের দুর্বলতার বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে দেখা যাচ্ছে যে এবারের লোকসভা নির্বাচনেও সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে মোদি ও বিজেপি।
সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে নরেন্দ্র মোদির প্রতি ভারতীয় নাগরিকদের মুগ্ধতা বা ভক্তি এখনো পুরোপুরি কমে যায়নি। প্রবাদপ্রতিম দলিত নেতা ও ভারতের সংবিধানের স্থপতি হিসেবে পরিচিতি বি আর আম্বেদকার বলেছিলেন, ভারতীয়রা বিশেষ করে ‘ভক্তি’ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকেন। ধর্মের ক্ষেত্রে এই ভক্তি ঠিক আছে। কিন্তু এটি যখন রাজনীতিতে এসে যায়, তখন অধঃপতনের পথ তৈরি হয় এবং পরিণামে একনায়কতন্ত্রের উদ্ভব হয়।
ভারতীয়রা এবারের লোকসভা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কি সেই পথেই এগোবে? ২৩ তারিখেই জানা যাবে তা।