আইএসে যাওয়া তিন ব্রিটিশ মেয়ের একজন ফিরতে চান
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনা। যুক্তরাজ্যের পূর্ব লন্ডনের স্কুলপড়ুয়া তিন বান্ধবীর একসঙ্গে নিখোঁজ হওয়া নিয়ে তুমুল হইচই পড়ে যায়। তিন দিন পর জানা যায়, তাঁরা জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সিরিয়ায় পাড়ি দিয়েছেন। সেই তিন মেয়ের একজন শামীমা বেগম এখন যুক্তরাজ্যে ফিরে আসার আকুতি জানিয়েছেন।
যুক্তরাজ্যের দৈনিক টাইমসের সাংবাদিক অ্যান্থানি লয়েড সম্প্রতি সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় একটি শরণার্থী শিবিরে সাক্ষাৎ পান শামীমার। ওই সাংবাদিককে শামীমা বলেন, তিনি নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এখন যেকোনো দিন তাঁর সন্তানের জন্ম হতে পারে। এর আগে অপুষ্টি আর রোগে ভুগে তাঁর দুই সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। নবাগত সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে তিনি যুক্তরাজ্যে ফিরতে চান। তবে আইএসে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি অনুতপ্ত নন বলে জানান।
সিরিয়ায় পাড়ি দেওয়ার সময় বেথনাল গ্রিন একাডেমির তিন ছাত্রীর মধ্যে শামীমা বেগম ও আমিরা আবাসির বয়স ছিল ১৫ বছর। অপর ছাত্রী খাদিজা সুলতানা ছিলেন ১৬ বছর বয়সী। তাঁদের তিন মাস আগে একই বিদ্যালয়ের ছাত্রী শারমিনা বেগম সিরিয়ায় পাড়ি দিয়েছিলেন। শারমিনার সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র ধরেই তিন মেয়ে একসঙ্গে সিরিয়ায় পাড়ি দেন বলে ধারণা। শামীমা বেগম, খাদিজা সুলতানা ও শারমিনা বেগম—এই তিনজন বাংলাদেশি পরিবারের সন্তান।
খাদিজা সুলতানা ২০১৬ সালে বোমা হামলায় নিহত হন বলে খবর পাওয়া গিয়েছিল। সাক্ষাৎকারে শামীমা বেগমও ওই মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি গেটউইক বিমনবন্দর দিয়ে তুরস্কে পাড়ি দেন তিন মেয়ে। সেখান থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে সিরিয়া যান। আইএস জঙ্গিরা সিরিয়া ও ইরাকের বিশাল একটি অংশ দখল করে ইসলামি খেলাফত রাষ্ট্র ঘোষণা করেছিল। যার রাজধানী ছিল সিরিয়ার রাক্কা শহর।
বর্তমানে ১৯ বছর বয়সী শামীমা বেগম বলেন, সিরিয়া প্রবেশ করে তাঁরা সরাসরি রাক্কায় চলে যান। সেখানে একটি ঘরে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা তরুণীদের একসঙ্গে রাখা হয় বিয়ে দেওয়ার জন্য। শামীমা ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সী ইংরেজি ভাষায় কথা বলে এমন ছেলেকে বিয়ের জন্য আবেদন করেন। ১০ দিনের মাথায় ২৭ বছর বয়সী ডেনমার্কের ধর্মান্তরিত এক ছেলের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।
শামীমা জানান, দুই সপ্তাহ আগে পছন্দ তিনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে আইএসের শেষ ঘাঁটি বাঘুজ এলাকায় ছিলেন। সেখান থেকে পালিয়ে আসার সময় তাঁর স্বামী সিরিয়ান বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। আর তিনি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় এই শরণার্থী শিবিরে প্রায় ৩৯ হাজার লোকের অবস্থান।
সিরিয়ায় তাঁর প্রত্যাশিত জীবন পেয়েছিলেন কি না?—এমন প্রশ্নের জবাবে শামীমা বলেন, রাক্কা শহরে তিনি প্রত্যাশিত জীবন যাপনই করছিলেন। যখন তখন বোমা হামলার ঘটনাগুলো বাদ দিলে সেখানে জীবন ছিল স্বাভাবিক। জীবনে প্রথমবারের মতো দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন মাথা দেখার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, একটি ময়লার ঝুঁড়িতে বিচ্ছিন্ন মাথা দেখে তিনি মোটেও বিচলিত হননি।
নিজের দুই সন্তানকে হারানোর কষ্টের কথা জানিয়ে শামীমা বলেন, তাঁর প্রথম সন্তান ছিল মেয়ে। ১ বছর ৯ মাস বয়সী ওই সন্তানকে ১ মাস আগে বঘুজ এলাকায় দাফন করেছেন। এর ৩ মাস আগে তাঁর ৮ মাস বয়সী দ্বিতীয় সন্তান মারা যায়। শামীমা বলেন, সেখানে প্রয়োজনীয় ওষুধ-চিকিৎসক কিছুই ছিল না। তাঁদের বঘুজ এলাকা ছাড়ার পেছনে এটিও একটি কারণ। তিনি বলেন, অনাগত সন্তান নিয়ে তিনি বেশ উদ্বিগ্ন। যুক্তরাজ্যে ফিরে তিনি সন্তানকে নিয়ে নীরব জীবন যাপন করতে চান। যুক্তরাজ্যে ফেরার জন্য তিনি সবকিছু করতে রাজি।
চার বছর আইএসের একজনের স্ত্রী হিসেবে সংসার করা শামীমা বলেন, আইএসের কথিত খেলাফত রাষ্ট্রের কোনো ভবিষ্যৎ দেখছেন না তিনি। তারা ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। আইএসের মধ্যে নিপীড়ন ও দুর্নীতি মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তাঁর স্বামীকেও জেলে বন্দী করা হয়েছিল বলে জানান। শামীমা মনে করেন না আইএস আর কোনো কিছু অর্জনের যোগ্য।
এখন প্রশ্ন হলো, শামীমা বেগম কি ফিরতে পারবেন? যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বেন ওয়ালেস ডেইলি মেইলকে বলেন, শামীমার যুক্তরাজ্যে ফিরে আসার অধিকার আছে। তবে তাঁকে ইরাক, তুরস্ক বা ওই অঞ্চলের অন্য কোনো ব্রিটিশ দূতাবাসে গিয়ে সাহায্য চাইতে হবে। কারণ সিরিয়ায় কোনো ব্রিটিশ কনস্যুলার সেবা নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসে যোগ দেওয়া কোনো সন্ত্রাসী বা সাবেক সন্ত্রাসীকে উদ্ধারের কাজে পাঠিয়ে কোনো ব্রিটিশ নাগরিকের জীবনকে তিনি ঝুঁকিতে ফেলতে চান না। তিনি বলেন, যেসব ব্রিটিশ নাগরিক সিরিয়ায় পাড়ি দিয়েছে এবং সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছে, তাদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।
টাইমসের সাংবাদিক অ্যান্থোনি লয়েড ডেইলি মেইলকে বলেন, ‘শামীমা যখন সিরিয়া পাড়ি দেয় তখন সে ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক। চার বছর পর এখন সে জিহাদির মগজধোলাই হওয়া স্ত্রী। যদিও সে অনুতপ্ত নয়; কিন্তু তার চোখে–মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যে সে এক দুর্বিসহ জীবন কাটিয়েছে। এখন সে নয় মাসের গর্ভবতী। আমি তাঁকে খুব কঠিনভাবে বিচার করতে চাই না।’