এত বোমার খয়খরচা কই পায় তালেবান?
আফগান তালেবান তার শক্তির জানান আরেকবার দিল। বিগত কয়েক মাসের মধ্যে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী হামলা চালিয়েছে তারা। লক্ষ্যবস্তু—দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী। নিহত শতাধিক।
গত সোমবার রাজধানী কাবুলের কাছে ওয়ারদাক প্রদেশে সামরিক বাহিনীর সুরক্ষিত প্রশিক্ষণকেন্দ্রে গাড়িবোমা হামলার পর এলোপাতাড়ি গুলি চালায় তালেবান। এমন সুরক্ষিত স্থানে ভয়াবহ হামলার ব্যাপকতায় চুপসে গেছে দেশটির সরকার। কীভাবে কী হলো, তা নিয়ে সরকার চিন্তিত।
সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর বহু সদস্যের প্রাণ নিয়ে তালেবান যে সক্ষমতা দেখিয়েছে, তা মোটেই বিস্ময়কর নয়।
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের হামলার মুখে তালেবানের পতন হলেও তারা নিশ্চিহ্ন হয়নি। বরং সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আফগানিস্তানে তালেবানের পুনরুত্থান ঘটেছে।
আফগানিস্তানে এখন তালেবানের সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। দেশটির একটা বড় অংশে তাদের সক্রিয় উপস্থিতি আছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তারা হুটহাট হামলা চালাচ্ছে। হামলার পরিমাণ দিনকে দিন বাড়ছে। এসব হামলায় শক্তিশালী বিস্ফোরক, অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও সরঞ্জাম ব্যবহার করছে জঙ্গিগোষ্ঠীটি। হামলাসহ সাংগঠনিক তৎপরতা জোরদার করতে প্রচুর অর্থ খরচ করছে তালেবান।
এত খয়খরচার অর্থ কোথায় পায় তালেবান?
দেশের ভেতর-বাহির উভয় উৎস থেকেই তালেবানের অর্থের জোগান আসে।
গত বছরের ডিসেম্বরে বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানায়, জঙ্গিবাদের খরচ মেটাতে তালেবান একটি অত্যাধুনিক আর্থিক নেটওয়ার্ক ও কর–ব্যবস্থা চালিয়ে আসছে।
তালেবানের আয় সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায়, তাতে চোখ কপালে ওঠার দশা। এখন আট বছর আগে তাদের বার্ষিক আয় ছিল প্রায় ৪০ কোটি ডলার। গত কয়েক বছরে তালেবানের প্রতিপত্তি যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে তাদের আয়। তালেবানের বর্তমান বার্ষিক আয় দেড় শ কোটি ডলার হতে পারে।
তালেবান স্বীকার না করলেও দেশের ভেতরে তাদের আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস মাদক। আফিমের উর্বর ভূমি আফগানিস্তান। সেই সুবাদে বিশ্বে আফিমের সবচেয়ে বড় উৎপাদনকারী দেশ তারা। এই সুযোগকেই লুফে নিয়েছে তালেবান। আফগানিস্তানে এখন তালেবান–নিয়ন্ত্রিত এলাকাতেই অধিকাংশ আফিম চাষ হয়। তারা আফিমচাষি, আফিম থেকে হেরোইন উৎপাদনকারী ও কারবারিদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে। আফিম অর্থনীতির জোরে তালেবানের অর্থভান্ডারও বাড়বাড়ন্ত।
অবৈধ মাদকের খাত থেকে তালেবানের বার্ষিক আয় ১০ থেকে ৪০ কোটি ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকতে পারে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভাষ্য, তালেবানের আয়ের ৬০ ভাগই মাদক খাত থেকে আসে।
আফগানিস্তানের প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকায় তালেবানের সরব উপস্থিতি রয়েছে। নিজেদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় তারা একটি কর–ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে কর আদায়ের মাধ্যমে তালেবানের বিপুল আয় হয়।
তালেবান চাঁদাবাজিও করে। জঙ্গিগোষ্ঠীটি বড় বড় ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে জোর করে বড় অঙ্কের চাঁদা আদায় করে।
পরিষেবা থেকে আয় হয় তালেবানের। এই যেমন তারা বিদ্যুৎ বিল বাবদ গ্রাহকের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে। আফগানিস্তানের ইলেকট্রিসিটি কোম্পানির প্রধানের ভাষ্য, বিদ্যুৎ বিল থেকে তালেবানের বার্ষিক আয় ২০ লাখ ডলারের বেশি।
আফগানিস্তানে প্রচুর খনিজ সম্পদ রয়েছে। তালেবান বিভিন্ন খনি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে অর্থ কামাচ্ছে। বৈধ বা অবৈধ পন্থায় যারা খনিজসম্পদ আহরণ করছে, তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে তালেবান। এক হিসাব অনুযায়ী, খনি থেকে তালেবানের বার্ষিক আসে ৫ কোটি ডলারের বেশি।
হামলা-দখলও তালেবানের আয়ের একটি মাধ্যম। কোথাও হামলা চালালে কোষাগারসহ অন্যান্য জিনিসপত্র তারা লুটে নেয়।
এ তো গেল দেশের কথা, বিদেশি উৎস থেকে প্রচুর অর্থ আসে তালেবানের হাতে। পাকিস্তান, ইরান ও রুশ সরকার তালেবানকে অর্থ দিয়ে সহায়তা করে আসছে বলে অভিযোগ আছে।
তা ছাড়া পাকিস্তান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতারসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যক্তিপর্যায়ে অর্থসহায়তা পায় তালেবান।
তালেবানকে দমানোর অন্যতম কৌশল তাদের আর্থিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া। সেই লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও আফগান সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু এ কাজে তারা যে খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না, তালেবানের অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতিই তা বলে দেয়।