ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটেই খাসোগির মৃত্যু

নানা নাটকীয়তার পর শেষ পর্যন্ত কনস্যুলেট ভবনের ভেতরেই সাংবাদিক জামাল খাসোগির মৃত্যু হয়েছে বলে স্বীকার করেছে সৌদি আরব। দেশটির দাবি, হাতাহাতি থেকে এই মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় গোয়েন্দা উপপ্রধান ও সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের এক উপদেষ্টাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৮ জন সৌদি নাগরিককে।
এর মধ্য দিয়ে খাসোগির ব্যাপারে তুরস্কের দাবি সত্য বলে প্রমাণিত হলো। ঘটনার ১৭ দিন পর ‘হাতাহাতির একপর্যায়ে খাসোগির মৃত্যু’ হয়েছে বলে বিবৃতি দিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। এর আগপর্যন্ত ঘটনার ব্যাপারে টানা অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছিল দেশটি।
২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবনে ব্যক্তিগত কাগজপত্র আনার প্রয়োজনে ঢোকার পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন সৌদির খ্যাতনামা সাংবাদিক খাসোগি। শুরু থেকে তুরস্ক দাবি করে আসছে, খাসোগিকে কনস্যুলেট ভবনের ভেতর সৌদি চরেরা হত্যা করেছে। গত বছর সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতা গ্রহণের পর রোষানলে পড়েন খাসোগি। তিনি দেশ ছেড়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ওয়াশিংটন পোস্ট–এ যুবরাজ মোহাম্মদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে একের পর এক কলাম লেখেন। অভিযোগ উঠেছে, যুবরাজের নির্দেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এ হত্যা সংঘটিত হয়েছে। সৌদি আরবের এ বিবৃতির মধ্য দিয়ে যুবরাজের ‘মধুচন্দ্রিমার’ যবনিকাপাত টানা হলো বলে মনে করছেন অনেকে।

আজ শনিবার বিবিসি অনলাইনের খবরে বলা হয়, এই প্রথমবার সৌদি আরব স্বীকার করল খাসোগির মৃত্যু হয়েছে। দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন প্রাথমিক প্রমাণের তথ্য তুলে ধরে জানিয়েছে, ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবনের ভেতরে হাতাহাতির একপর্যায়ে জামাল খাসোগি মারা যান। এতে বলা হয়, গোয়েন্দা উপপ্রধান আহমাদ আল-আসিরি ও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের জ্যেষ্ঠ ঘনিষ্ঠ সহযোগী সৌদ আল-কাহতানিকে এ ঘটনায় বরখাস্ত করা হয়েছে।
সৌদির প্রধান আইন কর্মকর্তা শেখ সৌদ আল-মোজেব বিবৃতিতে খাসোগির মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তবে খাসোগির দেহ কোথায় রাখা হয়েছে, এ ব্যাপারে তিনি কোনো তথ্য দেননি।
বিবৃতিতে বলা হয়, কনস্যুলেট ভবনের ভেতর যে লোকগুলোর সঙ্গে খাসোগির দেখা হয়েছিল, তাঁদের সঙ্গে তাঁর মারামারি হয়। একপর্যায়ে খাসোগি মারা যান। বিবৃতিতে খাসোগির আত্মার শান্তি কামনা করা হয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ঘটনার ব্যাপারে আরও তদন্ত চলছে। এ ঘটনায় ১৮ জন সৌদি নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
বরখাস্ত হওয়া সৌদ আল–কাহতানি ছিলেন সৌদি রাজ কোর্টের প্রভাবশালী সদস্য এবং যুবরাজ মোহাম্মদের উপদেষ্টা। টুইটারে তাঁর ১০ লাখেরও বেশি অনুসারী রয়েছে।
আর মেজর জেনারেল আহমদ আল-আসিরি ইয়েমেন যুদ্ধে সোদি আরবের শীর্ষ মুখপাত্র ছিলেন।

সৌদি আরবের হঠাৎ এই সুর পরিবর্তনের বিষয়টি তুলে ধরে বিবিসি অনলাইনের খবরে জানানো হয়, এত দিন অস্বীকৃতি জানানোর পর সৌদি আরব স্বীকার করছে কনস্যুলেট ভবনের ভেতরে খাসোগির মৃত্যু হয়েছে। তবে তুর্কি সরকারের তদন্তের সঙ্গে এর বৈপরীত্য দেখা যাচ্ছে। তুর্কি কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুসারে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে, পরিকল্পিতভাবে খাসোগিকে নির্যাতন, হত্যা ও হত্যার পর করাত দিয়ে দেহ টুকরো টুকরো করা হয়েছে। ১৭ দিন পর সৌদি সংস্করণ আনা হয়েছে সেই ঘটনায়। দাবি করা হচ্ছে, মারামারির ঘটনা থেকে খাসোগির মৃত্যু হয়েছে। সৌদির দাবি, এটা পূর্বপরিকল্পিত ছিল না। সৌদির এ ব্যাখ্যা ‘তালগোল পাকানো নাটকের’ মতো লাগছে।
সৌদি আরবের এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, যা ঘটেছে, তা ‘অগ্রহণযোগ্য’ কিন্তু সৌদি আরব তাঁদের ‘বড় মিত্র’।
এক গোলটেবিল বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, এই গ্রেপ্তারকে গুরুত্বপূর্ণ ‘প্রথম পদক্ষেপ’ বলা যায়। এত দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনায় তিনি সৌদির প্রশংসা করেন। সৌদির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে মার্কিন অর্থনীতিতে সম্ভাব্য কী প্রভাব পড়তে পারত সে ব্যাপারে কথা বলেন তিনি।

সৌদি ঘোষণার পরপরই হোয়াইট হাউস এক বিবৃতি দিয়েছে। এতে বলা হয়, খাসোগির মৃত্যুর নিশ্চিত খবর পাওয়ার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র ‘গভীরভাবে মর্মাহত’। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের কাছ থেকে জানতে পেরেছে যে জামাল খাসোগির ভাগ্যে কী ঘটেছে, সে ব্যাপারে দেশটির তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে এবং সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। এই দুঃখজনক ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্তের বিষয় আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি এবং আনুষঙ্গিক কাজসহ যথাসময়ে স্বচ্ছ ন্যায়বিচারের পরামর্শ দিচ্ছি। খাসোগির মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার খবরে আমরা ব্যথিত এবং তাঁর পরিবার, প্রেমিকা ও বন্ধুদের প্রতি আমাদের গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।’
তবে সৌদির এই তদন্তকে সন্দেহের চোখে দেখছেন মার্কিন সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম। রিপাবলিকান এই নেতা সৌদির বড় সমালোচক। তিনি বলেন, এত দিন সৌদি আরব অস্বীকৃতি জানিয়ে বলছিল, খাসোগি কনস্যুলেট ভবন থেকে বেরিয়ে গেছেন। এখন মারপিটের ঘটনা এবং সেই থেকে মৃত্যুর কথা বেরিয়ে আসছে। এত সবকিছু ঘটেছে, যুবরাজ মোহাম্মদ কিছুই জানতেন না।
গোয়েন্দা বিভাগের পুনর্গঠনে সৌদি বাদশাহ সালমান যুবরাজ মোহাম্মদের নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগে খাসোগির ঘটনায় সৌদি বাদশাহ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলেন।