উপাচার্য (ভিসি) নিজে ছিলেন আওয়ামী যুবলীগের নীতিনির্ধারণী পর্ষদ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকশন অফিসার পদে ১০ জন ও স্টোর অফিসার হিসেবে একজনকে নিয়োগ দিয়েছেন, যাঁদের নয়জনই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। বাকি দুজন চাকরি হয়েছে প্রশাসনের ‘পছন্দের’ কোটায়। এ ঘটনা ঘটেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর, এই ১১ জনের নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয় ‘একতরফা’ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের দিন ৪ জানুয়ারি।
শুধু তা-ই নয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল সেকশন অফিসার পদে চারজনের জন্য। কিন্তু এ পদে চাকরি হয়েছে ১০ জনের। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ছয় সহসভাপতি জুনায়েদ হোসাইন, মোস্তাফিজুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম, আলমগীর হোসেন, মাকসুদুর রহমান ও মো. রোহান, কর্মী সজিবুল ইসলাম, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আবদুল মালেক। বাকি দুজন—ফয়সাল আহমেদ ও জাহাঙ্গীর আলম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের পছন্দের কোটায় এসেছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া স্টোর অফিসার পদে নিয়োগ পেয়েছেন মঞ্জুরুল ইসলাম। তিনিও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সহসভাপতি।
৪ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের ৫৯তম সভায় এসব নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়।
মাস ছয়েক আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) পদে নিয়োগ পান যুবলীগের নীতিনির্ধারণী পর্ষদ কেন্দ্রীয় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মীজানুর রহমান। অবশ্য যুবলীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে প্রথম আলোকে জানানো হয়, উপাচার্য পদে যোগ দেওয়ার আগে মীজানুর রহমান যুবলীগ থেকে পদত্যাগ করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দাপ্তরিক নথিপত্রে দেখা যায়, গত বছরের ১৩ অক্টোবর চারজন সেকশন অফিসার, একজন স্টোর অফিসারসহ (গ্রেড-২) বিভিন্ন পদের জন্য সংবাদপত্রে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এতে ছাত্রলীগের প্রায় ৫০ জন নেতা-কর্মীসহ মোট ৪৭০ জন চাকরিপ্রার্থী আবেদন করেন।
অভিযোগ রয়েছে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শরিফুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলামের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী সেকশন অফিসার পদে আটজন নেতা-কর্মী ও স্টোর অফিসার পদে একজনের চাকরি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ করেছেন নিয়োগবঞ্চিত ছাত্রলীগের একাধিক নেতা-কর্মী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রলীগের একজন নেতা বলেন, তিনি নিজে চাকরিপ্রার্থী ছিলেন। কিন্তু সংগঠনের নেতাদের চাহিদা মোতাবেক টাকা দিতে না পারায় তাঁর চাকরি হয়নি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি শরিফুল ইসলাম এই অভিযোগ অস্বীকার করেন। তাঁর দাবি, ‘নিয়োগের জন্য ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে কোনো তালিকা দেওয়া হয়নি। কোনো টাকাপয়সাও তাঁরা নেননি।
অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির প্রভাবশালী একজন নেতা তালিকা দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে এও বলেন, তাঁদের তালিকার বাইরেও সেকশন অফিসার পদে দুজনের নিয়োগ হয়েছে। ওই দুজন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের পছন্দের প্রার্থী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মীজানুর রহমান দাবি করেন, ‘ইন্টারভিউতে যারা ভালো করেছে, যাচাই-বাছাই করে তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এতে কোনো দলের নেতা-কর্মীরা আসল, তা আমাদের দেখার বিষয় নয়।’
সেকশন অফিসার পদে চারজনের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কেন ১০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হলো? এ প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য বলেন, এটা তাঁরা করতে পারেন।
প্রসঙ্গত, এর আগে ২০১২ সালে সাবেক উপাচার্য মেসবাহউদ্দিন আহমেদ সেকশন অফিসার পদে নয়জনের জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ছাত্রলীগের ২২ নেতা-কর্মীকে নিয়োগ দিয়ে বিতর্কিত হয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, এক বছরের মাথায় তাঁদেরকে গ্রেড-১-এ পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল।
উপপ্রধান প্রকৌশলী নিয়োগে অনিয়ম: উল্লিখিত ১১ জনের পাশাপাশি ৪ জানুয়ারির সিন্ডিকেট সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী সুকুমার চন্দ্র সাহাকে উপপ্রধান প্রকৌশলী পদে নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়। এ নিয়েও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
গত বছরের আগস্টে দেওয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ওই পদে আবেদনের জন্য নয় বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। কিন্তু নথিপত্র অনুযায়ী, সুকুমার সাহার চাকরির বয়স হলো আট বছর আট মাস। তিনি ২০০৯ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীর পদে অস্থায়ী নিয়োগ পান। ২০১১ সালের ১২ ডিসেম্বর তাঁকে স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে তিনি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন। সেই অভিজ্ঞতা যোগ করলেও নয় বছর হয় না।
সুকুমার চন্দ্র সাহা দাবি করেন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির আগে তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। কিন্তু উপপ্রধান প্রকৌশলী পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিকে অভিজ্ঞতা হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হবে না।
এ বিষয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যথারীতি দাবি করেছেন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী নিয়োগ-প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।