ঘটনা সামান্য, কিন্তু তার ফল হলো অসামান্য।
আগে ঘটনাটা বলি।
মিজান মাহমুদ সকালে অফিসে গেলেন। কফি খেলেন। তিনি পরপর দুই কাপ কফি খান কিন্তু আজ খেতে পারলেন না। মিটিংয়ে ডাক পড়ল। একটা মাল্টি ন্যাশনালের বিজ্ঞাপন বানাচ্ছেন তাঁরা। মিজান মাহমুদ দুর্ধর্ষ এক আইডিয়া দিয়েছেন। মিজান আশা করছেন, এই আইডিয়া মাল্টি ন্যাশনাল গিলে খাবে। ফলে কফি ফেলে মিটিংয়ে যাওয়া যায়।
কিন্তু মিটিংয়ে গিয়ে মিজান দেখলেন তাঁর আইডিয়া ছিনতাই হয়ে গেছে। আর ছিনতাইয়ের কাজটি করেছেন তাঁরই বস। তাঁরই আইডিয়া সগর্বে পেশ করছেন বস। মাল্টি ন্যাশনাল জড়িয়ে ধরছে বসকে। বলছে, ‘এ কী শোনাইলেন, ভাই! এ কী শোনাইলেন!’
মিজানকে দেখেই বস বললেন, ‘এসেছেন? দেখেন, ওনারা আমার আইডিয়াটা খুব পছন্দ করছেন!’
মিজান বলেন, ‘কিন্তু বস, আইডিয়াটা তো...’
বস বললেন, ‘সেইটাই বলছি ওনাদের... এইটা শুধু আমার আইডিয়া তো না... এই আইডিয়া আপনারও, এই অফিসের সবার... এই শহরের সবার... এই দেশের সবার... কী বলেন আপনি, তাই না?’
মিজান আরও কিছু বলতে চাইছিলেন। কিন্তু কলিগ ফাহমিদ তাঁকে টেনে নিয়ে গেলেন বারান্দায়। বললেন, ‘সবই তো জানি, ভাই! কিন্তু কী করবেন... বস মানুষ, চাইপা যান! ঘটনা তো সামান্যই!’
তবে এই সামান্য ঘটনার পরই ঘটল অসামান্য ঘটনা। সেদিনের পর থেকে টানা সাত দিন হয়ে গেল মিজান টয়লেটে গেলেন ঠিকই। কিন্তু কোনো ফল এল না।
প্রথম দুদিন মিজান কোনো গুরুত্ব দিলেন না। নিজের মতো অফিসে ও বাসায় ডিউটি করতে থাকলেন। কিন্তু ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও বড় বাবু যখন বেরিয়ে এলেন না, মিজানুরকে তাঁর পিতার ইসবগুলের ভুসিতে হাত দিতেই হলো।
ইসবগুলের ভুসি এক আশ্চর্য জিনিস।
এটা কোথায় উৎপাদিত হয়, কী করে এর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, মিজান কিছুই জানেন না। কিন্তু নিজের কাঠিন্যের কথা বলতেই প্রায় একবাক্যে সবাই এই নিদান দিতে থাকলেন।
‘ও এই ঘটনা, কোনো অসুবিধা নাই, এক গ্লাস ইসবগুলের ভুসি খাও। রাস্তা ক্লিয়ার!’
‘তাই নাকি? চার দিন? আমার তো সাড়ে পাঁচ দিন ছিল। ইসবগুল খান না, ভাই। ডাইরেক্ট অ্যাকশন!’
‘সকালে খাও।’
‘রাইতে খা, ভাই।’
‘গুলায়া খা।’
‘চুষে খা।’
‘চিবিয়ে খা।’
পরের সাত দিন মিজান ইসবগুলের ওপরেই থাকলেন। লাভের মধ্যে লাভ হলো পেট ফুলে একটা বেলুন হয়ে গেল। মনে হয় যেকোনো সময় উড়ে যাবেন মিজান। একবার মনে হলো, মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি উঠেও গেলেন ওপরে। কিন্তু যা নিচে নামা দরকার, নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র মেনেও সেটি আর নামে না। মিজান পড়লেন মহা বিপাকে। এ ধরনের দুর্বিপাক যে জীবনে আসতে পারে, তা চল্লিশের কঠিন যাপনে কখনো তিনি ভাবেননি।
রহমত হেসে বলল, ‘সাপ যদি আসতে পারে তাইলে আপনার কোষ্ঠও আসবে, দুলাভাই। আলতামিরের বীণের কাছে প্রাণ-অপ্রাণের কোনো ভেদাভেদ নাই। আপনি খালি কায়দা করে বসেন তো!’ বিপদে পড়লে মানুষ খড়কুটা আঁকড়ে ধরে। নিজের এমন কঠিন বিপদে মিজান আলতামির ও তাঁর বীণ আঁকড়ে ধরলেন।
২.
চিকিৎসকের শরণ নিলেন মিজান। চিকিৎসক ওষুধ আর আস্থা দিলেন। তাতে আরও তিন দিন কাটল। কিন্তু কী আশায় বাঁধি খেলাঘর... কোষ্ঠের বালুচরে!
মিজানের ক্ষণ তিষ্ঠানো দায়, এমন অবস্থা! বাথরুমের পাশে স্থায়ী আসন নিয়ে বসলেন। ভুসিবিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞান উভয়ই যখন ফেল মারল, তখনই এল টোটকা-বিজ্ঞান! সেই টোটকায় পানের বোঁটা থেকে জোলাব গোটা... কী নেই! কিন্তু সবচেয়ে উদ্ভট যে টোটকা, সেটা নিয়ে হাজির হলেন মিজানের স্ত্রীর ভাই। বিষয়টা একটু বিস্তৃত করে না বললেই নয়!
দুলাভাইয়ের এমন আট কুঠুরি নয় দরজা বন্ধ হওয়ার খবর পেয়েই রহমত আলী রাজশাহী থেকে এক ভোরে এসে উপস্থিত হলো। সঙ্গে সাপুড়ে আলতামির। রহমত আলীর ভাষ্যমতে, আলতামির অতি বিখ্যাত সাপুড়ে। তাঁর খ্যাতি মোহনপুর গ্রামের সীমান্ত পেরিয়ে ইন্ডিয়া অবধি গেছে। পাসপোর্ট-ভিসা করে ইন্ডিয়া থেকে লোক আসে তাঁর তাবিজকবজ নিতে। শুধু মানুষ নয়, আলতামির বীণ বাজাতে ধরলে ৪০ হাত মাটির নিচ থেকে সাপ বেরিয়ে আসে। ফণা নামিয়ে আলতামিরের পায়ের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
মিজান মিনমিন করে বললেন, ‘তো?’
রহমত হেসে বলল, ‘সাপ যদি আসতে পারে তাইলে আপনার কোষ্ঠও আসবে, দুলাভাই। আলতামিরের বীণের কাছে প্রাণ-অপ্রাণের কোনো ভেদাভেদ নাই। আপনি খালি কায়দা করে বসেন তো!’
বিপদে পড়লে মানুষ খড়কুটা আঁকড়ে ধরে। নিজের এমন কঠিন বিপদে মিজান আলতামির ও তাঁর বীণ আঁকড়ে ধরলেন। তিনি কায়দা করে বসলেন। আলতামির বীণ বাজাতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ বাজিয়েই আকাশের দিকে তাকিয়ে কাকে যেন ধমক দিয়ে বললেন, ‘ত্যাঁদড়! মহা ত্যাঁদড়! কিন্তু আমিও কি তারে ছাইড়া দিমু... আয় আয়...’
আলতামির আবার বীণ বাজাতে শুরু করলেন। কিন্তু যা আসবে বলে সবাই এত উদ্গ্রীব, তা এল না! আলতামির চোখ দুটো রক্তজবার মতো করে বীণ বাজাতেই থাকলেন। কিন্তু হলো না, কিছুই হলো না!
রহমত আলী বলল, ‘আশ্চর্য! এতক্ষণে অ্যানাকোন্ডা আইসা হাজির হইয়া যাইত, আপনি আসলে রাখছেন কী প্যাটের ভিতর?’
মিজান উত্তর দিলেন না। কায়দা করে বসে থাকতে থাকতে তাঁর কোমর ধরে এসেছিল, তিনি ওই অবস্থাতেই পড়ে গেলেন।
৩.
চোখ খুলে মিজান নিজেকে পেলেন হাসপাতালের কেবিনে। যা শুনলেন, তা ভয়াবহ। একটু পরই তাঁর অপারেশন হবে। ইতিমধ্যে চিকিৎসকেরা তাঁকে নিয়ে দুই দফা বোর্ড মিটিং করে ফেলেছেন। সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। অপারেশন করে পেটের ভেতরের মালমসলা ফেলে দেওয়া হবে। আর কোনো কারণে যদি অপারেশন সাকসেসফুল না হয়, তাহলে মিজানকে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া হবে। প্লেন তৈরি আছে। মিজান খুবই ঘাবড়ে গেলেন।
এরই মধ্যে কেউ কেউ মিজানের সঙ্গে দেখাও করতে এলেন। কারও হাতে ফুল, কারও মুখে জিজ্ঞাসা... কেউ কেউ ঢুকলেনই নাক কুঁচকে... সব শেষে এলেন মিজানের বস। মুখে একটা চিন্তার মুখোশ আর মেকি আস্থা দেওয়ার প্রবণতা। যাওয়ার আগে হঠাৎ যেন মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বস বললেন, ‘শোনেন, এই অ্যাডটা তো এখন বাজারে... হেবি হিট করছে, বুঝলেন!’
মিজান হাত ইশারায় বসকে কাছে ডাকলেন। বস এগিয়ে আসতেই ঠাস করে একটা চড় মারলেন বসের বাঁ গাল বরাবর। ক্লিন শেভড গালটা একেবারে কেঁপে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে মিজানের পেটটাও কেমন যেন নড়েচড়ে উঠল। মিজান নার্সকে ডাকতে পারতেন, কিন্তু ইচ্ছা করল না...।