কোনো ব্যক্তি নেদারল্যান্ডস ভ্রমণ করেছেন অথচ ডাচ ক্লগ সম্পর্কে জানবেন না, এমনটি হওয়ার নয়। ডাচ জাতি পুরো বিশ্বের কাছে পরিচিত তাদের রং-বেরঙের টিউলিপ, ডাচ চিজ, উইন্ডমিল আর এই ঐতিহ্যবাহী কাঠের জুতার জন্য।
ডাচ ভাষায় এই কাঠের জুতাকে বলা হয় ক্লোম্পেন (Klompen); যা মধ্যযুগ থেকেই নেদারল্যান্ডসে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। নেদারল্যান্ডসের ১২টি প্রদেশের যেকোনো ট্যুরিস্ট শপে গেলেই দেখা মেলে চাবির রিং, কাপড়, হ্যান্ডব্যাগসহ নানা ধরনের স্যুভেনিরে রয়েছে ডাচ ক্লগ নামের কাঠের এই রঙিন জুতার ছবি।
এমন নয় যে কাঠের জুতার ব্যবহারের ইতিহাস শুধু নেদারল্যান্ডসেই রয়েছে। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ধরনের কাঠের জুতা ব্যবহার করা হয়, যেমন জাপানের ‘গেটা’ এবং স্পেনের ‘আলবারকাস’। তবে গঠনশৈলীর দিক থেকে সামনের দিকে সুচালো পায়ের আঙুল এবং হাত দিয়ে আঁকা কাঠের জুতা সাধারণত ‘ডাচ ক্লগ’ হিসেবে স্বীকৃত। কাঠের জুতা ডাচ সংস্কৃতিতে গভীরভাবে যুক্ত এবং গ্রামীণ অঞ্চলের কিছু মানুষ এখনো এই জুতা ব্যবহার করেন।
ইতিহাস খুঁজে বেড়ানোর অভিপ্রায় থেকে কাঠের জুতার বিষয়েও জানার চেষ্টা করি। ইতিহাস বলছে, ১২০০ শতকে কাঠের তৈরি জুতার ব্যবহার শুরু হয় নেদারল্যান্ডসে। কারখানার শ্রমিক, কারিগর, কৃষক, জেলেদের পা রক্ষার জন্য নকশা করা হয়েছিল এই জুতার। তবে শুরুতে পুরো কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়নি, সে সময় কাঠের ওপর চামড়া ব্যবহার করা হতো। কিন্তু লক্ষ্য করা গেল, মাঠে, পানিতে ও কারখানায় কাজ করার জন্য সেগুলো খুব উপযোগী নয়। পরবর্তী সময়ে পুরো জুতাই কাঠ দিয়ে তৈরি করা হলো। তবে পেশার ভিন্নতায় জুতার নকশাতেও ভিন্নতা এল। যাঁরা খামারে পিট খনন করতেন, তাঁদের পা কাদায় ডুবে যেত, তাই জুতায় একটি বৃহৎ বর্গাকার নাক ব্যবহার করা হতো। মাছ শিকারের তার জড়ো করতে জেলেরা ব্যবহার করতেন জুতার সামনের দিকে ধারালো ও সুচালো নাকযুক্ত ক্লগ। কারখানার কর্মীদের জুতা ছিল সাদাসিধে।
তবে ধীরে ধীরে এর ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও। বাড়িতে পরার জন্যও জুতা তৈরি শুরু হয়। এমনকি গির্জা ও বিয়ের অনুষ্ঠানে পরার জন্য বিশেষ কাঠের জুতা বেশ জনপ্রিয় হতে শুরু হলো পুরো নেদারল্যান্ডসে। একপর্যায়ে এমন প্রথা শুরু হলো, পুরুষেরা তাদের বাগদত্তার কাছে এক জোড়া সুন্দর খোদাই করা জুতা দিয়ে প্রপোজ বা ভালো লাগার কথা বলত।
যেভাবে তৈরি হয় ডাচ ক্লগ
বিশেষ ধরনের কুড়াল দিয়ে কাঠের একটি টুকরাকে জুতার প্রাথমিক আকার দেওয়া হয়। সেটিকে পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয় তিন কি চার দিন। এরপর একটি ধারালো ছুরি দিয়ে জুতার পূর্ণাঙ্গ আকার দেওয়া হয়। জুতা তৈরির পর তিন সপ্তাহজুড়ে রোদে শুকানো হয়। শুকিয়ে গেলে হাতে আঁকা হয় নকশা। জুতা বানানোর মেশিন উদ্ভাবিত হয় শিল্পবিপ্লবের পর। স্বাভাবিকভাবেই তখন উৎপাদন যায় বেড়ে। তবে নেদারল্যান্ডসে এখন হাতে গোনা কয়েকজন এমন জুতা তৈরি করেন। তাদের কারখানায় জুতা তৈরি দেখার সুযোগ রয়েছে।
নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামের অদূরে ঐতিহ্যবাহী ডাচ সংস্কৃতির জন্য জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র জায়ানস শ্যাঞ্চস। এটি একটি ছোট্ট গ্রাম, যেখানে বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে খোলা আকাশের নিচে রয়েছে একটি জাদুঘর। সেখানেই রয়েছে কাঠের জুতা তৈরির কারখানা। কারিগরেরা পর্যটকদের কাছে দারুণভাবে উপস্থাপন করেন তৈরির প্রক্রিয়া। সেখানে জুতা কেনারও ব্যবস্থা আছে। কারখানা ভ্রমণে গিয়ে কেনার সুযোগ না হলেও, সামনে রাখা নানা রঙের, নানা মাপের ও নানা নকশার কাঠের জুতা পরে ইচ্ছামতো ছবি তুলেছি।