২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

তোমার তো মাথাব্যথাই নেই

মাথাব্যথা কার নেই? নানা কারণে নানা ধরনের মাথাব্যথায় ভুগি আমরা। মাথাব্যথা আদতে রোজকার বিষয়। তাই মাথাব্যথা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং সহজভাবে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। ৬-১২ সেপ্টেম্বর ‘মাইগ্রেন ও মাথাব্যথা সচেতনতা সপ্তাহ–২০২০’। এ উপলক্ষে আমাদের সপ্তাহব্যাপী আয়োজনের আজ দ্বিতীয় দিন। আজ থাকছে মাথাব্যথা নিয়ে রম্য গল্প...

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

ওয়ার্ডরোবের ড্রয়ার খুলে কিছু একটা উল্টেপাল্টে আবার ড্রয়ার ঠেলে দিতে দিতে হঠাৎ করেই তনু বলল, ‘ছোট মামি ফোন করেছিলেন। মামার ফ্লাইট নাকি ৫ তারিখ। মামি আর শুভ আগামীকাল ঢাকায় আসছেন।’

আমি মোবাইলের স্ক্রিনে মেসি-বার্সার একটা ট্রলে হা হা দিতে দিতে বললাম, ‘কই, আমাকে তো কিছু বলল না!’

তনু মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘বললে কী করতা? তোমার কী এসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথা আছে?’

তনুর সঙ্গে সোয়া চার বছরের প্রেম্পত্য (তিন বছর প্রেম + সোয়া বছর দাম্পত্য) জীবন কাটাচ্ছি। আমাকে নিয়ে তনুর একটাই অভিযোগ, আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। এই কবছরে আমাকে সবচেয়ে বেশিবার যে কথা শুনতে হয়েছে তা হলো, ‘তোমার তো এ বিষয়ে কোনো মাথাব্যথাই নেই।’

বাসায় তনুর বিয়ের কথা চলছে। তনু মুখ গম্ভীর করে, ছলছল চোখে আমাকে বলে, ‘বাবা আজকে আকারে–ইঙ্গিতে বিয়ের কথা বলেছেন। বলবেন না কেন? কাজিনকুজিন কেউ তো আর বাকি নেই। আত্মীয়স্বজনও তো আছে কথা শোনানোর জন্য। অবশ্য এসব তোমাকে বলেই বা কী লাভ! তোমার তো এ বিষয়ে কোনো মাথাব্যথাই নেই।’

তনু কোনোভাবে কিছুদিন বিয়ের তোড়জোড় ঠেকিয়ে রাখে। কিন্তু তারপরই হয়তো আবার একদিন এসে বলে, ‘আগামীকাল আরেকটা পার্টি আসবে দেখতে। কদিন পরপর সং সাজতে আমার আর ভালো লাগছে না।’

আমি স্ট্র দিয়ে স্প্রাইটে সুড়ুৎ করে টান দিয়ে হালকা গলায় বলি, ‘ছেলে কী করে, জানতে পেরেছ? আগেও বলেছি, বিসিএস ক্যাডারের নিচে যাওয়া কোনোভাবেই ঠিক হবে না তোমার। সবার কাছে গর্ব করা যাবে—আমার এক্সের হাজবেন্ড একজন বিসিএস ক্যাডার।’

‘ভড়ং বাদ দাও। তুমি হিমু না। অবশ্য তোমার ভাবসাব দেখে মনেই হয় যে আমার বিয়েতে তোমার কিছু যায়–আসে না। এ নিয়ে তোমার কোনো মাথাব্যথাই নেই।’

আকাশে থালার মতো চাঁদ ওঠে। কোত্থেকে এক ঝটকা ঠান্ডা বাতাস এসে গায়ে লাগে। মেসেঞ্জারে তনয়া নামক একজন মায়াবতীর মেসেজ আসে, ‘আজকের চাঁদটা দেখেছ?’

চাঁদের দিকে তাকিয়েই আমি রিপ্লাই দিই, ‘চাঁদ উঠেছে নাকি আজকে!’

তনু জ্যোৎস্নাপাগল। নিজের ফেসবুক প্রোফাইলের বায়োতে লিখে রেখেছে ‘Selenophile’। অনেকক্ষণ পর ওর মেসেজ আসে।

‘Do you have a heart? জ্যোৎস্না নিয়ে তোমার কোনো মাথাব্যথা নেই কেন?’

আমি আপনমনে হাসি। তনু এতক্ষণ ‘ঝগড়া করব, না করব না’ ব্যাপারে বোঝাপড়া শেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে।

জ্যোৎস্নার মতো একটা মায়াবী ব্যাপারে কারও মাথাব্যথা থাকবে কেন! চতুর্দশীর চাঁদের দিকে তাকিয়ে তনুর মায়াকাড়া মুখ, শান্ত দুই চোখের কথা মনে করে আমার যে আনন্দে খুন হয়ে যেতে ইচ্ছা করে, বুকের ভেতর যে হাহাকারটা হয়, তনুকে পাশে পাওয়ার যে তীব্র ইচ্ছাটা জাগে, তনু কি সেটাকেই ‘মাথাব্যথা’ বলে?

তনুর অভিযোগ পুরোপুরি ভিত্তিহীন। আমার মাথাব্যথা আছে এবং সেটাও ভালো রকমের—মাইগ্রেন পেইন। সিরিয়াস সব বিষয়েই আমার মাথাব্যথা হয়। বাংলাদেশ হারলে, রিয়াল মাদ্রিদ চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে নকড আউট হলে রাতে ঘুম হয় না। পরদিন কপালের শিরা দপদপ করে।

বিয়ের পর তনুর অভিযোগ আরও বেড়ে যায়।

‘বাড়িওয়ালা কী শুরু করছে এসব। আজকে সারা দিন এক ফোঁটা পানি আসেনি। তোমার জি হুজুর, জি হুজুর–টাইপ কথাবার্তার জন্যই এ অবস্থা। রান্নাবান্না তো করা লাগে না। এসব নিয়ে মাথাব্যথা থাকবে কেন তোমার!’

‘নুহার বার্থডের কথা মনে আছে তো? নাকি সব আমাকেই করতে হবে? তা তো হবেই। এসব বার্থডে–ফার্থডে নিয়ে তোমার মাথাব্যথা হবে কেন!’

‘এই একটা মাস্ক তুমি কদিন ধরে পরতেছ? একটা মাস্কও কিনতে মনে থাকে না? তা থাকবে কেন! বাসায় দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসো করোনা। কার কী হলো তাতে তোমার তো মাথাব্যথা নেই!’

‘বলেছিলাম, দেশি ডাল আনতে। নিয়া আসছ মোটা মোটা ইন্ডিয়ান ডাল। দুই ঘণ্টা ধরে চুলায়। এখনো সেদ্ধ হওয়ার নাম নেই। সেদিন নিয়া আসলা পচা ইলিশ মাছ। কাটতে গিয়েই আমার নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসতেছিল।’

ডাল আর ইলিশ মাছ থেকে কাহিনি গড়ায় পোকাধরা বেগুনে। সেখান থেকে টার্ন নিয়ে খোলা, গন্ধহীন পাঁচফোড়নে। তারপর পাঞ্চ লাইন, ‘যে যেটা ধরায় দেবে, সেটাই নাচতে নাচতে নিয়ে আসবে। ভালো-খারাপ নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই নেই!’

তনুর অভিযোগ পুরোপুরি ভিত্তিহীন। আমার মাথাব্যথা আছে এবং সেটাও ভালো রকমের—মাইগ্রেন পেইন। সিরিয়াস সব বিষয়েই আমার মাথাব্যথা হয়। বাংলাদেশ হারলে, রিয়াল মাদ্রিদ চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে নকড আউট হলে রাতে ঘুম হয় না। পরদিন কপালের শিরা দপদপ করে। আমাদের অফিসের বস আজগর সোবহানের সামনে মিনিট পাঁচেক বসলেই মাথা চিনচিন করে। বিরিয়ানিতে আলু কম পাওয়ার হতাশায় আমার মাথা ধরে। পত্রিকা পড়ার পর মাথা ধরে, ফেসবুকে স্ক্রল করলে মাথা ধরে...এমন হাজারটা বিষয় আছে।

এমনকি এই যে তনু অভিযোগ করে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই, ওর মাথা ধরলেও অস্থিরতায় আমার মাইগ্রেনের অসহ্য ব্যথা শুরু হয়। তনু সব জানে।

তবুও ওর অভিযোগ থামে না। মাঝেমধ্যে আমার মাথাব্যথাহীনতা নিয়ে তনুর সঙ্গে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়। মুখে মুখে যতটা না, মনে মনে তার চেয়ে ঢের বেশি। আমার মাথা দপদপ করে। মনে হয় কেটেই ফেলি! লাইটমাইট নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকি। খানিক বাদেই বামের গন্ধ টের পাই। কপালে আঙুলের ছন্দময় ছুটে চলা টের পাই। মাথার চুলে অপার্থিব চোখবোজা আরামের টানাটানি টের পাই।

তনু ড্রয়ার হাতড়ায় প্যারাসিটামলের জন্য। নেই! স্বগোতক্তি করে, ‘একটাও প্যারাসিটামল নাই। গত সপ্তাহ থেকে বলতেছি। আছে এক অজুহাত “মনে নাই”! থাকবে কীভাবে, এসব নিয়ে তো কোনো...’

আমি আপন মনে হাসি। মাথার চুলে এলোমেলো বিলি কাটার অপার্থিব চোখবোজা আরাম নিয়ে ভাবি, লাইফে ‘মাথাব্যথা’ না থাকাটা তেমন খারাপ কিছু না!

আরও পড়ুন