১০ বছর আগের কথা ভাবুন, তারকাখ্যাতির জন্য কী করতে হতো? এককথায় বললে সাধনা। আর রাতারাতি তারকাখ্যাতি তো কেবল রূপকথাতেই সম্ভব ছিল। কিন্তু সেই রূপকথা কিংবা অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেছে আধুনিক প্রচারমাধ্যম। তার বড় এক প্রমাণ ওপরের ছবিটি। চেক শার্ট ও হাতাকাটা জ্যাকেট পরা টেকো মাথার এক ব্যক্তি কোমরে হাত দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তাঁর চোখে ও শরীরী ভাষায় রাজ্যের হতাশা, আছে বিরক্তিও। এর আগে এই ছবি আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন। বিশেষ করে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও টুইটারে আপনার পদচারণ নিয়মিত হলে তো অবশ্যই দেখেছেন। মূলত মিম আকারেই ছবিটি চোখে পড়েছে আপনার। অনেকেই হয়তো এই ছবিওয়ালা মিম শেয়ারও করেছেন।
মিম হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এই ছবি ২০১৯ সালের ১২ জুনের। ক্রিকেট বিশ্বকাপে সেদিন পাকিস্তান মুখোমুখি হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার। ম্যাচের একপর্যায়ে পাকিস্তানের আসিফ আলী সহজ এক ক্যাচ ফেলে দেওয়ার পর গ্যালারিতে এভাবেই দাঁড়িয়ে হতাশা প্রকাশ করেন এই পাকিস্তানি দর্শক। ক্যামেরা ধারণ করে ফেলে দৃশ্যটি। পরে ওই দৃশ্য হয়ে যায় ভাইরাল। ভিডিও থেকে নেওয়া ছবিটি হয়ে ওঠে মিম।
যেভাবে তিনি মিমের চরিত্র হলেন
ছবিটি ইন্টারনেটে ভাইরাল হতে সময় লাগেনি। তবে অন্যান্য ভাইরাল ‘জিনিসের’ মতো এই মিম সময়ের গর্ভে হারিয়েও যায়নি। এখনো হরহামেশাই বিভিন্ন উপলক্ষে বিভিন্নজনের পোস্টে এর দেখা মেলে। ২০১৯ সালের সেদিন টেলিভিশনের পর্দায় ওই দর্শকের হতাশাগ্রস্ত মুখটি প্রচারিত হওয়ার পরপরই ফেসবুক–টুইটারে তা মিম আকারে ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি খেয়াল করার সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেট উপস্থাপক জয়নব আব্বাস গ্যালারিতে গিয়ে তাঁর সাক্ষাৎকারও নেন।
জয়নবকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওই মুহূর্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ক্যাচটা ছিল খুবই সহজ এবং আমার চোখের সামনে এভাবে ক্যাচটা মিস করতে দেখাটা ছিল ভীষণ হতাশার। সেই হতাশাই হয়তো আমার চেহারায় ছাপ ফেলেছে। কারণ, আমি দেখেছি, বলটা তাঁর হাতেই ছিল, কিন্তু তারপরও তিনি তা ফেলে দিলেন।’
ঠিক পরদিনই আইসিসির টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে হতাশ পাকিস্তানি দর্শকের ছোট্ট ভিডিওটি আপলোড করা হয়। চার মাসের কম সময়ের মধ্যে ভিডিওটিতে ২০ হাজারের বেশি লাইক পড়ে, রিটুইট করা হয় ৩ হাজার ৩০০ বার। একই দিনে এক ক্রিকেটপ্রেমী শেয়ার করেন ছবিটি। আর সেটি লুফে নেয় ম্যাশাবল, নিউজএইটিন, ইন্ডিয়া টুডে, এমএসএনসহ বিশ্বের আরও অনেক প্রচারমাধ্যম। পরদিন আবার ছবির ওই ব্যক্তি নিজেই টুইটারে লেখেন, ‘লাভিং দ্য মিম গাইজ। নেক্সট ম্যাচ ইজ ক্রুশাল।’
ব্যস, সেই থেকে হতাশ দর্শক হয়ে গেলেন মিমের চরিত্র। মিমটি একাধিক নামে পরিচিত—তার মধ্যে বেশি প্রচলিত হলো ‘ডিজঅ্যাপয়েন্টেড ক্রিকেট ফ্যান’, ‘ডিজঅ্যাপয়েন্টেড ফ্যান’ এবং ‘অ্যাংরি পাকিস্তানি ফ্যান’।
কে এই হতাশ দর্শক
মিমটির আরেক নাম হলো ‘ডিজঅ্যাপয়েন্টেড মুহাম্মদ সারিম আখতার’। বুঝতেই পারছেন, মুহাম্মদ সারিম আখতার হতাশ ওই ব্যক্তির নাম। ইন্টারনেট ঘেঁটে যেসব তথ্য পাওয়া গেল, তাতে বোঝা যায়, সারিম আখতারের নামধাম খুঁজে বের করা হয়েছে ২০১৯ সালেই। তবে ২৪ অক্টোবর টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের বিশাল জয়ের পর আবার আলোচনায় এসেছেন তিনি। লিংকডইনে তিনটি ছবি দিয়ে ‘ওভার দ্য মুন রাইট নাউ’ লিখে পোস্ট দেওয়ার পরই মূলত এই আলোচনা।
এবার অবশ্য পুরোনো ছবির হতাশ মুখের জায়গায় হাসিমুখের ছবি বসিয়ে দিয়েছেন তিনি। আর তার পরপরই বিষয়টি আবারও ভাইরাল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে পাকিস্তানের নাগরিক মুহাম্মদ সারিম আখতারের অ্যাকাউন্টে ফলোয়ারের সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে সারিম থাকেন লন্ডনে। ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বিখ্যাত প্রাইসওয়াটারহাউস কুপারস কোম্পানিতে। এক মিমের কল্যাণে দুনিয়ার নানা প্রান্তের মানুষ তাঁকে এখন চেনে।
এক সাক্ষাৎকারে সারিম বলেন, ‘এক ব্যক্তি একদিন আমাকে ফোন করে বলেন, আমার ক্রেডিটকার্ডে তোমার ওই ছবি ব্যবহার করতে চাই। এ জন্য তোমার অনুমতি দরকার। আমি বললাম, এতে অনুমতি নেওয়ার কী আছে! এটা তো আনন্দের ব্যাপার! আর ওই ছবির মালিক তো আমি নই। ওই ব্যক্তি জানান, ক্রেডিটকার্ডওয়ালারা অনুমতি নিতে বলেছে, অনুমতি না পেলে তারা আমার কার্ডে তোমার ছবি ছাপবে না।’
এটা তো মাত্র একটি উদাহরণ। এমন আরও অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন সারিম। গত বছর আইসিসি তাদের টুইটার অ্যাকাউন্টে ওই মিম শেয়ার করে দ্বিতীয় বার্ষিকী উদ্যাপন করেছে। এ পর্যন্ত নানান মাধ্যমে একাধিক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সারিম। কিংবদন্তি ক্রিকেটার ওয়াসিম আকরামের সঙ্গে একটি প্রচারণাতেও অংশ নিয়েছেন। লোকজন তাঁর ওই ছবি দিয়ে টি–শার্ট বানিয়ে পরছে। মগে, ক্যাপে, দেয়ালে শোভা পাচ্ছে তাঁর মুখ। হংকংয়ের মিউজিয়াম অব মিমসেও জায়গা করে নিয়েছে সারিমের ছবি। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিটি দিয়ে কত রকমের মিম যে হয়েছে, তার কোনো লেখাজোখা নেই!
তাহলে এবার আপনিই বলুন, আজকাল তারকাখ্যাতি পাওয়া সহজ কি না? সহজ, তবে কেউ জানে না কে কখন কীভাবে খ্যাতিমান হয়ে যাবে! সারিম নিজেও তো জানতেন না, ২০১৯ সালের ১২ জুন লন্ডন থেকে তিন ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে সমারসেটের টনটন শহরে গিয়ে গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে তিনি তারকা বনে যাবেন!