ঘুরে ঘুরে এবি নেগেটিভ রক্তদান

ইমাম হোসাইন ও এম এ মাসুদ পারভেজ স্বেচ্ছায় রক্ত দেন
ছবি: সৌরভ দাশ

যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীদের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশের রক্তের গ্রুপ এবি নেগেটিভ। তথ্যটি আমেরিকান ন্যাশনাল রেডক্রসের। পরিসংখ্যান ভিনদেশের হলেও এবি নেগেটিভ রক্তের মানুষ যে বাংলাদেশেও সহজে মেলে না, তা বোঝা যায় প্রয়োজনের সময়। অনেক সময় মানুষের খোঁজ মেলে হয়তো, কিন্তু রক্তদানে আগ্রহী মানুষ হন কতজন! এম এ মাসুদ পারভেজ আর ইমাম হাসান এখানেই ব্যতিক্রম।

চট্টগ্রামের তরুণ ইমাম হোসাইন এবং এম এ মাসুদ পারভেজ স্বেচ্ছায় রক্ত দেন। দুজনের পরিচয়ও রক্তদানের সূত্রেই। কারও এবি নেগেটিভ রক্তের প্রয়োজনে নিজের এলাকায় তো দেনই, অনেক সময় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, ঝিনাইদহ জেলায় গিয়েছেন তাঁরা। হাসিমুখে রক্ত দিয়েছেন। তাঁদের রক্তে সুস্থ হয়েছেন মুমূর্ষু রোগী, রক্ত প্রাপ্তির অনিশ্চয়তায় থমকে থাকা অস্ত্রোপচার হয়েছে সফল। এমন অসংখ্য রক্তদানের গল্প দুজনের ঝুলিতে।

এসব গল্প শোনার সুযোগ হলো ৯ জুন, মুঠোফোনে। মাসুদ পারভেজ বর্তমানে বান্দরবান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট। ইমাম হোসাইন মাদ্রাসা শিক্ষায় স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পড়াশোনা সম্পন্ন করেছেন। পারিবারিক ব্যবসায় যুক্ত। রক্তদান নিয়ে নানা উদ্যোগের সঙ্গেও আছেন।

ইমামের রক্তের গ্রুপ ‘পচা’

ইমাম হোসাইনের একজন শিক্ষকের শাশুড়ি মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে ছিলেন। তাঁর জন্য জরুরি রক্তের প্রয়োজন পড়ল। যথাসাধ্য চেষ্টা করে বি পজিটিভ রক্ত জোগাড় করতে পারছিলেন না সেই শিক্ষক। এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ইমাম তাঁর শিক্ষককে জানালেন রক্তদানের আগ্রহের কথা। তবে দুজনের কেউ নিজেদের রক্তের গ্রুপ জানেন না।

ইমামের শিক্ষক তাঁদের নিয়ে হাসপাতালে গেলেন। দুজনের রক্ত পরীক্ষা করা হলো। ইমামের বন্ধুর রক্তের গ্রুপ জানা গেল বি পজিটিভ। তিনি রোগীর জন্য রক্ত দিলেন। ইমাম হোসাইনের রক্ত যিনি পরীক্ষা করলেন, তাঁর চক্ষু চড়কগাছ।

‘রীতিমতো ভীতি ধরিয়ে দিলেন আমাকে। তিনি বললেন, “এই রক্তের (এবি নেগেটিভ) গ্রুপের মানুষ বেশি দিন বাঁচে না।” আমার পাশে থাকা বন্ধু সেটা শুনেছিল। মাদ্রাসায় এসে সবাইকে সে বলে দিল—আমার রক্ত পচা!’ বলছিলেন ইমাম হোসাইন।

এবি নেগেটিভ রক্ত যে সহজে মেলে না, ইমাম তখনো এ ব্যাপারে জানতেন না। ২০১১ সালের সেই ঘটনার পরই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলেন ইমাম। তাঁর ভাগনির রক্তের প্রয়োজন ছিল ও নেগেটিভ। ইমাম চেয়েছিলেন হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে নিজের এক ব্যাগ রক্তের বিনিময়ে ভাগনির জন্য রক্তের ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু কে জানত, এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবেন। তিনি বলছিলেন, ‘যখন ব্লাড ব্যাংকে গিয়ে বললাম, রক্ত দেব। তাঁরা পরীক্ষা করে দেখলেন, আমার এবি নেগেটিভ। তখন রক্ত না নিয়ে আমার মোবাইল নম্বর ও বাড়ির ঠিকানা লিখে রাখলেন। আর জানালেন, আপাতত রক্ত দিতে হবে না, প্রয়োজনে তাঁরাই ডাকবেন।’ সবার আগ্রহ দেখে ইমাম বুঝলেন, তাঁর গ্রুপের রক্ত সহজে মেলে না, ‘দামি’ রক্ত।

মাসুদ পারভেজের রক্তের গ্রুপ জানার ব্যাপারটিও একই রকম। এক নিকটাত্মীয়ের রক্তের প্রয়োজন ছিল। তিনি গ্রুপ জানতেন না। ছুটে গিয়েছিলেন রক্ত দিতে। গ্রুপ মেলাতে রক্ত নমুনা পরীক্ষা করা হলে জানলেন, এবি নেগেটিভ।

ইমাম হোসাইন ও এম এ মাসুদ পারভেজ
ছবি: সৌরভ দাশ

রক্তের পরিচয়

চট্টগ্রামের স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতাদের অনলাইনভিত্তিক সংগঠন সিটিজি ব্লাড ব্যাংক। গ্রুপে সদস্যসংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ১৮ হাজার। রক্তদান ছাড়াও শীতবস্ত্র বিতরণ, ব্লাড গ্রুপিং, রক্তদানে উৎসাহিত করা ও থ্যালাসেমিয়া মুক্তির লক্ষ্যে সচেতনতামূলক প্রচারণা, অসহায় রোগীদের সাহায্য করা ও বন্যার্তদের ত্রাণ বিতরণ। ইমাম হোসাইন সিটিজি ব্লাড ব্যাংকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। সিটিজিসহ ফেসবুকভিত্তিক বিভিন্ন রক্তদাতা গ্রুপের সঙ্গে ইমাম হোসাইন ও মাসুদ পারভেজ যুক্ত আছেন।

২০১৩ সালের কথা। চট্টগ্রাম রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে এক রোগীর জন্য রক্তের প্রয়োজন ছিল। ফেসবুকে পোস্ট দেখে হাসপাতালে হাজির হয়েছিলেন ইমাম হোসাইন। সেখানে গিয়েছিলেন মাসুদ পারভেজও। দুজনই রক্তদান করেছেন। এরপরই দুজনের সখ্য।

সেই সখ্য পারিবারিক রূপ পেয়েছে। কথা বলার সময়ই জানলাম, মাসুদ পারভেজের স্ত্রী অসুস্থ, সেই খবর জেনে ইমাম হোসাইন হাজির হয়েছেন তাঁর পাশে। কথা বলতে বলতে মনে হলো, তাঁদের এ বন্ধন যেন ‘রক্তের’।

দুজনের আরও গল্প

২০১৩ সাল থেকেই দুজনে বিভিন্ন জেলায় গিয়ে রক্তদান করছেন। এর মধ্যে একবার জানতে পারলেন, সিলেটে একজনের রক্তের প্রয়োজন। রক্তের অভাবে অস্ত্রোপচার থেমে আছে। চট্টগ্রাম থেকে ছুটলেন মাসুদ পারভেজ ও ইমাম হোসাইন। তাঁদের রক্ত পেয়ে অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হলো। দীর্ঘ ক্লান্তিকর ভ্রমণের কষ্ট ভুলে হাসিমুখে বিদায় নিলেন দুজন।

আরেকবার রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) রক্তের প্রয়োজন ছিল একজনের। ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপগুলোতে পোস্ট করেও রক্তদাতা পাচ্ছিলেন না রোগীর পরিবার। সেখানেও ছুটে আসেন দুজন।

তবে ইমাম হোসাইনের সবচেয়ে দূরের যাত্রা ছিল ঝিনাইদহ। সেবার মাসুদ পারভেজ সঙ্গে ছিলেন না। মালয়েশিয়াপ্রবাসী একজনের পায়ে পচন ধরছিল। তাঁর অস্ত্রোপচার। শুরুতে স্থানীয়ভাবে রক্ত জোগাড় করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু দুদিনেও রক্তদাতা পাওয়া যায়নি, হাজির হন ইমাম হোসাইন।

ইমাম হোসাইন বলছিলেন, ‘রোগীর স্বজনেরা যখন হাসিমুখে কথা বলে, তখন যাত্রার কষ্ট আর কষ্ট মনে হয় না। এখন আমরা এবি নেগেটিভ রক্তদাতাদের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছি। সব জেলা থেকেই মানুষ আমাদের সঙ্গে যুক্ত আছেন। চেষ্টা করি স্থানীয়ভাবে ব্যবস্থা করার।’

সতেরোর সংবর্ধনা

মাসুদ পারভেজ ও ইমাম হোসাইনের মাঝে সংবর্ধনা আয়োজনের উদ্যোক্তা নজরুল ইসলাম

২০১৭ সালে চট্টগ্রাম থেকে কিশোরগঞ্জে এসেছিলেন মাসুদ পারভেজ ও ইমাম হোসাইন। রক্তদান করতে এসেছেন শুনে ভৈরবের রক্তদাতা সংগঠনের সদস্যরা দুজনকে রীতিমতো সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। সেই সংবর্ধনা আয়োজনের উদ্যোক্তা ছিলেন নজরুল ইসলাম। তিনিও স্বেচ্ছা রক্তদাতা, কাজ করেন রক্তদান নিয়ে। নজরুল বলছিলেন, ভালো কাজের জন্য মানুষকে উৎসাহী করা উচিত, এই চিন্তা থেকেই তাঁদের সংবর্ধনা দিয়েছিলাম। তাঁদের ফুলেল সংবর্ধনা দিতে দেখে ভৈরব শহরের মানুষজন কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। কারা তাঁরা, কেন সংবর্ধনা—এই ছিল সকলের জিজ্ঞাসা!’

ভালোবাসা মনে রাখেন

রক্তদান করতে গিয়ে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন ইমাম হোসাইন ও মাসুদ পারভেজ। কিন্তু সেসব ভুলে মানুষের ভালোবাসার কথাই মনে রেখেছেন দুজন। এখনো অনেক রোগীর স্বজন তাঁদের খোঁজ নেন, পারিবারিক কোনো আয়োজনে আমন্ত্রণ জানান। তাই তো মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘দিন শেষে আমি ভালোবার কথাই মনে রাখি।’