দক্ষিণ মেরু যেন পৃথিবীর ভেতরেই অন্য এক পৃথিবী। এটা পৃথিবীর সবচেয়ে শীতল, ঝোড়ো আবহাওয়াপূর্ণ এবং শুষ্ক স্থান। দক্ষিণ মেরুতে সব দিক উত্তর দিকে নির্দেশ করে। অর্থাৎ এখানে বাকি তিনটি দিকের কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। এ কারণে দক্ষিণ মেরুতে মূল মধ্যরেখার সাপেক্ষে দিক নির্ণয় করা হয়। স্থানটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ৮৩৫ মিটার ওপরে ২ হাজার ৭০০ মিটার পুরু বরফে ঢাকা মালভূমিতে অবস্থিত। অর্থাৎ দক্ষিণ মেরুর প্রকৃত ভূপৃষ্ঠ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার প্রায় সমান। সেখান থেকে সবচেয়ে নিকটবর্তী সমুদ্র ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার দূরের ‘বে অব হোয়েলস’। দক্ষিণ মেরুতে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত বছরে একবারই হয়, ফলে দক্ষিণ মেরুকে কোনো নির্দিষ্ট সময় অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দক্ষিণ মেরুতে সূর্যের দেখা মেলে না। এর মধ্যে মে থেকে জুলাই পর্যন্ত অঞ্চলটি একেবারেই অন্ধকার থাকে। অন্য সময় সামান্য গোধূলির আলো পাওয়া যায়। সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সূর্যকে ডুবতে দেখা যায় না। সূর্যটা ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘোরে বলে মনে হয়। আর সূর্যের অবস্থান থাকে আকাশের নিচের দিকে। ডিসেম্বর মাসে সর্বোচ্চ সাড়ে ২৩ ডিগ্রি পর্যন্ত ওঠে।
প্রথম মানুষ হিসেবে দক্ষিণ মেরু জয় করেন নরওয়ের অভিযাত্রী রোয়াল্ড এমান্ডসেন। তিনি দক্ষিণ মেরুতে পা রাখেন ১৯১১ সালে। এর প্রায় এক মাস পর রবার্ট ফ্যালকন স্কট দলবল নিয়ে দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছান। তবে ফেরার পথে তিনি ও তাঁর সহযাত্রীরা তীব্র ঠান্ডা ও খাবার ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে প্রাণ হারান। ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ অভিযাত্রী আর্নেস্ট স্যাকেলটন জাহাজ নিয়ে দক্ষিণ মেরু পাড়ি দেওয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন। কিন্তু তাঁর জাহাজ বরফে আটকা পড়ে যায় এবং এর ১১ মাস পর তিনি মারা যান।
এরপর আমেরিকার অভিযাত্রী রিচার্ড বায়ার্ড প্রথম ব্যক্তি হিসেবে বিমানে চেপে দক্ষিণ মেরুর ওপর দিয়ে উড়ে যান। রিচার্ড বায়ার্ড মার্কিন নৌবাহিনীতে কাজ করতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন পাইলট হিসেবে। ১৯২৪ সালে তাঁকে গ্রিনল্যান্ডে নিযুক্ত করা হয়। তাঁর দায়িত্ব ছিল আকাশপথে উত্তর মেরু অঞ্চলের অন্বেষণ করা। হিমবাহ এবং সামুদ্রিক বরফের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতায় আকৃষ্ট হয়ে বায়ার্ড উত্তর মেরুতে প্রথম ফ্লাইটের চেষ্টা করেন। কিন্তু বিমানের তেলের ট্যাংকে ছিদ্র হওয়ার কারণে উত্তর মেরেুর ১৫০ মাইল দূর থেকে ফিরে আসেন। এরপর তিনি দক্ষিণ মেরুর ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
১৯২৯ সালের ২৮ নভেম্বর বেলা সাড়ে তিনটার দিকে রিচার্ড বায়ার্ড, পাইলট বার্ন্ট বালচেন ও ফ্লয়েড বেনেট ‘লিটল আমেরিকা’ বেজক্যাম্প থেকে দক্ষিণ মেরুতে যাত্রা করেন। চৌম্বকীয় কম্পাসগুলো মেরুর কাছাকাছি অকেজো ছিল বলে অভিযাত্রীরা সূর্যের ওপর নির্ভর করেছিলেন। আর নেভিগেটর হিসেবে আস্থা রাখতে হয়েছিল বায়ার্ডের দক্ষতার ওপর। রাত আটটার দিকে তাঁরা কুইন মাউড পর্বতমালার কাছে পৌঁছান। এর এক ঘণ্টা পর পৌঁছে যান পোলার মালভূমিতে। এটা ছিল যাত্রার সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং পর্যায়। অভিযাত্রীরা দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছান ২৯ নভেম্বর রাত ১টার দিকে। সময়টা রাত ১টা হলেও তখন আকাশে সূর্য ছিল। এরপর তাঁরা সকাল ১০টার দিকে নিরাপদে ‘লিটল আমেরিকা’ বেজক্যাম্পে অবতরণ করেন। এই কৃতিত্বের জন্য বায়ার্ডকে মার্কিন নৌবাহিনীর ‘রিয়ার অ্যাডমিরাল’ পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
বায়ার্ড ১৯৩৯ সালে মার্কিন অ্যান্টার্কটিক সার্ভিসের কমান্ড গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি মার্কিন নৌবাহিনীর অন্যতম শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন। অ্যান্টার্কটিকায় তাঁর পঞ্চম এবং শেষ অভিযানের নেতৃত্ব দেন ১৯৫৫ সালে। এর দুই বছর পর, ১৯৫৭ সালে তিনি মারা যান।
বায়ার্ড ছিলেন বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত বিমানচালক। দক্ষিণ মেরুতে অভিযান পরিচালনা করার ক্ষেত্রে অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছিলেন। তাঁর প্রধান কৃতিত্ব ছিল দক্ষিণ মেরু অন্বেষণে বিমান, বেতার, ক্যামেরা এবং অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করা। তাঁর অভিযানগুলোয় স্কি প্লেন, জাহাজভিত্তিক সি প্লেন এবং এমনকি হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছিল। নৌযানভিত্তিক বিমান চলাচল ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি করেছিলেন তিনি।
বায়ার্ডের জীবনে অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা ঘটে ১৯৩৪ সালে। সে বছর শীতকালে বায়ার্ড তাঁর দ্বিতীয় অ্যান্টার্কটিকা অভিযানে ‘লিটল আমেরিকা’ বেজক্যাম্প থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে বরফে নিচে চাপা পড়েন এবং ‘বোলিং অ্যাডভান্স বেজ’ নামে একটা আবহাওয়া স্টেশনের কুঁড়েঘরে একা পাঁচ মাস কাটিয়েছিলেন। তখন ওই স্থানের তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ৫০ থেকে মাইনাস ৬০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। পাঁচ মাস পর যখন তাঁকে উদ্ধার করা হয়, তখন তিনি মারাত্মক অসুস্থ ছিলেন।