কথাcom
‘কে বস, কে কিং, এসবে কিছু যায় আসে না’
তাঁকে ফলের রাজা বলা হয়। বেড়ে ওঠা থেকে ‘কিং’ হওয়া, অভিমান, আক্ষেপ, নস্টালজিয়া—এসব নিয়ে কারওয়ান বাজারের জব্বার মিয়ার ভ্যানের এক সিনিয়র আম কথা বলেছেন কথাcom প্রতিবেদক শরীফ মজুমদার–এর সঙ্গে।
আমাদের সৌভাগ্য, শেষ মুহূর্তে হলেও আপনাকে পেলাম।
ধন্যবাদ। আমিও অত্যন্ত ‘আমন্দিত’।
এই যে মুকুল থেকে গুটি হয়ে ধীরে ধীরে পরিপক্ব হওয়া, এরপর টক থেকে রসাল...এই জার্নিতে কোন সময়টা আপনার কাছে সেরা মনে হয়?
অফকোর্স চাইল্ডহুড। মুকুল থেকে বের হয়ে নিজের একটা জগৎ হতে দেখা, একটামাত্র চিকনচাকন বোঁটা দিয়ে মা গাছের সঙ্গে শক্তভাবে জুড়ে থাকতে দেখা—জাস্ট আম-এ-জিং!
আগের বেড়ে ওঠা আর এখনকার বেড়ে ওঠার মধ্যে কী তফাত দেখতে পান?
হিউজ ডিফারেন্স। আগে যেমন ন্যাচারালি বড় হতাম। অথচ এখন না চাইলেও কার্বাইড–টার্বাইড খেয়ে অকালপক্ব হই। অনেকটা ‘ফার্মের আম’ বলতে পারেন।
এই যে বছরে একবার আসেন। মাস দুয়েক বাজার দাপিয়ে আবার চলে যেতে হয়। খারাপ লাগে না?
তা তো লাগবেই। অনেক দিন আর কেউ মনে রাখবে না। বাট এটাই তো নিয়ম। আপনি জীবনানন্দ পড়েছেন না? ওই যে, কী একটা কবিতায় তিনি বলেছেন—
‘...পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়,’
নক্ষত্র যেখানে মরে যায়, সেখানে আম-রা কোন ছার!
আপনি দেখি জীবনানন্দ দ্বারা বেশ প্রভাবিত!
বেশ না, অল্পই। তবে আমার পোয়েটিক সেন্স বলে, তিনি মেটাফোর ভালো জানতেন না। যেমন ধরেন, তিনি বলেছেন, শঙ্খচিল শালিকের বেশে বাংলায় ফিরতে চান। এটা না বলে যদি বলতেন,
‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে—এই বাংলায়, হয়তো মানুষ নয়—হয়তো বা ফজলি, ক্ষীরসা, ল্যাংড়ার বেশে।’ তাহলে কিন্তু এই কবিতার আবেদন অনেক বেড়ে যেত। রিচ বাড়ত। অথচ ভুলভাল মেটাফোরের জন্যই কিন্তু আমজনতার কাছে তিনি খুব একটা রিচ করতে পারেননি।
রিচ প্রসঙ্গে মনে পড়ল, কয় দিন আগে মরিচের ঝাল টের পেয়েছেন নিশ্চয়ই। সবাই মরিচকে ‘ম-rich’ বলে ট্রল করল, মিম–টিম বানাল। বাজার যখন আপনাদের মতো সুইট একটা ফলের দখলে, আপনাদের দাম না বেড়ে একটা অতি সাধারণ ঝাল জিনিসের দাম বেড়ে গেল, ভাইরাল হলো—এটা কীভাবে দেখেন?
সত্যি বলতে, আমের কাছে দাম ম্যাটার করে না। আর আম-রা তো আজীবনই ভাইরাল। আমেদের কাছে যেটা ম্যাটার করে, সেটা হলো অ্যাকসেপটেন্স, রিচ হওয়া না। সামার নিয়ে বিদেশের মানুষের থাকে ইমোশন, আর আমাদের আমোশন। এতেই তো বোঝা যায়, আমজনতা আমাদের সঙ্গে আছে।
অন্য প্রসঙ্গে আসি। আপনাদের এই যে এত এত জাত, কখনো জাতিগত বিদ্বেষের কথা মনে হয়নি?
নাহ্। আপনি দেখেন, একই ভ্যানে আমরা ফজলি, আম্রপালি, হিমসাগর, ল্যাংড়া যেমন থাকি; তেমনি আশ্বিনা, হাঁড়িভাঙ্গা, গোপালভোগও থাকে। বাট আমরা গায়ে গা লাগিয়েই আমতরিকতার সাথে থাকি। আমাদের মধ্যে কোনো ক্লাস কনফ্লিক্ট নাই। কে বেশি সুইট, কার স্মেল বেশি, কার খোসা পাতলা, কার নাম কী—উই জাস্ট ডোন্ট কেয়ার। আমাদের মধ্যে কোনো তোমরা, তারা নেই, আম-রা সব সময়ই ‘আমরা’।
আপনার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। অথচ আপনি না হয়ে জাতীয় ফল হলো কাঁঠাল, এটা নিয়ে কোনো অভিমান বা আক্ষেপ আছে?
শুনেন, আমেদের ডিকশনারিতে ‘ডিপ্রেশন’ বলে কোনো শব্দ নেই। আমি সো কল্ড ওই ফল না যে আমি হ্যান আমি ত্যান বলে বেড়াব। ফ্যানদের ভালোবাসাই আমার বড় পাওয়া। কে বস, কে কিং, এসবে কিছু যায় আসে না। একজন খেয়ে একটু আয়েশে চোখ বুজল, গাল বেয়ে টুপ করে একটু রস পড়ল, আমার হ্যাপিনেসের জায়গা ওইটা এবং এই হ্যাপিনেস আনপ্যারালাল। আরও বিষয় আছে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, দেশের জিআই নির্দেশক ১২টি পণ্যের মধ্যে ২টিই কিন্তু আমেদের। সো, এই যে দেশকে ইউনিকলি রিপ্রেজেন্ট করা, এটাই তো সবচেয়ে বড় ব্যাপার, তাই না?
জি, অবশ্যই। একটা অস্বস্তিকর প্রশ্ন। আপনারা ফলের রাজা, অথচ সে হিসেবে আপনাদের নামগুলো, ফর এক্সাম্পল, যেমন ধরেন গোপালভোগ, হাঁড়িভাঙ্গা, ক্ষীরসাপাতি...এগুলো কি আপনাদের সঙ্গে যায়? আপনার কি মনে হয় না যে আপনাদের নামগুলো আরেকটু ‘পশ’ হওয়া দরকার ছিল?
আহা, বললাম তো। আমাদের কাছে রস ম্যাটার করে, পশ না।
শেষ প্রশ্ন। এক কথায় যদি বলেন, আপনাদের সুপ্রিমেসির জায়গা কোনটি?
আপনি কাঁঠালের আমসত্ত্ব শুনে থাকবেন, কিন্তু আমের কাঁঠালসত্ত্ব শুনবেন না। ডাজন্ট দ্যাট মেক এভরিথিং ক্রিস্টাল ক্লিয়ার?
হা হা। খুবই ডিপ্লো-আমেটিক অ্যানসার দিয়েছেন। সব শেষে কথাcom–এর পাঠকদের জন্য কিছু বলতে চান?
কথা একটাই—যাচ্ছি, কিন্তু যাচ্ছি না।