ফিলিস্তিনি মুক্তিসংগ্রামের মহান নেতা ইয়াসির আরাফাত আজীবন একটা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্ন লালন করেছেন। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য তিনি সংগ্রাম করেছেন অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে। নির্বাসিত জীবনের গ্লানি সহ্য করেছেন, এক দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন অন্য দেশে। কখনো সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে, আবার কখনো আলোচনার টেবিলে বসে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবি জানিয়েছেন বারবার। জীবনের শেষ দিনগুলোতে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখে। গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ২০০৪ সালের ১১ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।
ইয়াসির আরাফাতের জন্ম ১৯২৯ সালে মিসরের কায়রোতে। কায়রোর ইউনিভার্সিটি অব কিং ফুয়াদ ওয়ানে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন ১৯৪৪ সালে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করলে তিনি অন্য ছাত্রদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন এবং ফিলিস্তিনের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৪৯ সালের প্রথম দিকে কায়রো ফিরে এসে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনায় ফিরে যান ইয়াসির।
১৯৫০ সালে স্নাতক সম্পন্ন হলে ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যোগ দেন রাজনীতিতে। ১৯৫৯ সালে কুয়েতে নির্বাসিতকালে ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মুক্তির সংগঠন ‘ফাতাহ’ গঠন করেন। পরবর্তী সময়ে এই সংগঠনের নাম হয় প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)। ১৯৬৭-৬৮ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে সম্মুখসারিতে থেকে যুদ্ধ করেন ইয়াসির আরাফাত।
১৯৬৯ সালে তিনি নির্বাচিত হন পিএলওর চেয়ারম্যান হিসেবে। এ সময় তিনি জর্ডানে নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন। ১৯৭০ সালে জর্ডান থেকে চলে যান লেবাননে। লেবাননের রাজধানী বৈরুতে গড়ে তোলেন পিএলওর সদর দপ্তর। ১৯৮২ সালে ইসরায়েল লেবানন আক্রমণ করলে পিএলওর সদর দপ্তর তিউনিসে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৯৩ সালে ইয়াসির আরাফাত ফিরে আসেন ফিলিস্তিনে।
প্রথম দিকে ইসরায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার না করলেও ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে ইয়াসির আরাফাত নিজের অবস্থান পরিবর্তন করেন। ফিলিস্তিনের স্বায়ত্তশাসন মেনে নিলে ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি হন। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ১৯৯১ সালে মাদ্রিদ সম্মেলন, ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি এবং ২০০০ সালে ক্যাম্পডেভিড সম্মেলনের মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে কয়েক দশকের সংঘাতের অবসান ঘটানোর চেষ্টা করেন তিনি। ফিলিস্তিনি জনগণের একটা অংশ ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি আলোচনার পক্ষে ছিল না। ফলে এই সময় হামাস ও অন্যান্য সংগঠনের উত্থান ঘটে, যারা ইয়াসির আরাফাতের ভিত্তি দুর্বল করে দিয়ে ফিলিস্তিনের বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে নেয়।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ২০০২ সাল থেকে ইয়াসির আরাফাতকে পশ্চিম তীরের রামাল্লায় তাঁর সদর দপ্তরে অবরুদ্ধ করে রাখে। এ সময় তাঁকে বাইরের দুনিয়া থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়। ইয়াসির আরাফাত তখন ঠিকমতো চিকিৎসাও পাননি। ২০০৪ সালের ২৫ অক্টোবর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে কদিন পর ইয়াসির আরাফাতকে ফ্রান্সের একটা হাসপাতালে নেওয়া হয়।
গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেও ইয়াসির আরাফাত চিকিৎসার জন্য ফিলিস্তিনের বাইরে যেতে চাননি। ভেবেছিলেন, ফিলিস্তিনের বাইরে গেলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাঁকে আবার ফিলিস্তিনের মাটিতে পা রাখতে দেবে না। ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাকের সঙ্গে ইয়াসির আরাফাতের ভালো সম্পর্ক ছিল। জ্যাক শিরাক ফ্রান্সের একটা সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে তিনি ফ্রান্সে যেতে রাজি হন। তা ছাড়া ইয়াসির আরাফাত এই বিশ্বাস নিয়ে ফ্রান্সে গিয়েছিলেন যে সুস্থ হয়ে আসার পর ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাঁকে ফিলিস্তিনে ফিরতে না দিলে জ্যাক শিরাক এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবেন। কিন্তু ফিলিস্তিনের মাটিতে ফিরে আসার স্বপ্ন সফল হয়নি এই মহান নেতার। আট দিন সংজ্ঞাহীন অবস্থায় থেকে ১১ নভেম্বর পরলোকগমন করেন তিনি। পরদিন মিসরের রাজধানী কায়রোয় জানাজা শেষে তাঁর মরদেহ ফিলিস্তিনের রামাল্লায় আনা হয়। পিএলও সদর দপ্তর প্রাঙ্গণে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে আবার জানাজা শেষে তাঁকে দাফন করা হয়।
ইয়াসির আরাফাতের রহস্যজনক অসুস্থতা ও মৃত্যুর ঘটনায় ইসরায়েলকে দায়ী করা হয়। ফরাসি চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, এক্স-রেতে দেখা গেছে, তাঁর গলা থেকে অন্ত্র পর্যন্ত ভেতরটা এমনভাবে পুড়ে গেছে যে মনে হচ্ছিল তাঁর খাবারের সঙ্গে বিষাক্ত কিছু মিশ্রিত ছিল। তাঁর রক্তে প্লাটিলেট কমে গিয়েছিল। কিন্তু রক্তে প্লাটিলেট দেওয়া হলেও রক্তের অবস্থা অপরিবর্তিতই থেকে যায়। চিকিৎসকেরা বুঝতে পারেন, তাঁর দেহে বাইরে থেকে কিছু একটা অনুপ্রবেশ করেছে। কিন্তু তাঁরা বিষাক্ত বস্তুটির পরিচয় ও তার অবস্থান নির্ণয় করতে ব্যর্থ হন। তাঁর মৃত্যুসনদে লেখা হয়েছিল, ‘নির্ণয় করা যায়নি এমন এক কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।’
ইয়াসির আরাফাতকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হতে পারে, এমন সন্দেহ ওঠায় মৃত্যুর প্রায় আট বছর পর ইয়াসির আরাফাতের দেহাবশেষ কবর থেকে তোলা হয়। এক বছর গবেষণার পর সুইজারল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা তাঁর হাড়ে উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয় পদার্থ পোলোনিয়ামের অস্তিত্ব পান। ফলে এ ধারণা বদ্ধমূল হয় যে ইসরায়েল তাঁকে তেজস্ক্রিয় পদার্থ প্রয়োগ করে হত্যা করেছিল।